
করোনাযুদ্ধে সামনের সারির যোদ্ধা হলেন চিকিত্সক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। অথচ বাংলাদেশে সেই চিকিৎসকসহ সেবাকর্মীরা রয়েছেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। করোনা ভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতি আমেরিকাসহ বিশ্বের কোনো দেশেই ছিল না। কিন্তু সংকটের মধ্যে তারা দ্রুত সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্যে চিকিত্সাব্যবস্থা ঠিক রেখেছে। চিকিৎসক-নার্সসহ সেবাকর্মীদের কাছে মানসম্পন্ন পিপিই-মাস্ক দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। হাসপাতালের পাশে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ দীর্ঘ চার মাস সময় পেলেও চিকিৎসাসেবার আশানুরূপ প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারেনি। চিকিত্সক-নার্সদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে নিম্নমানের মাস্ক ও পিপিই। আর এসব মাস্ক-পিপিই ব্যবহার করে ১০৭ জন চিকিত্সক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগেই আছেন ৮৫ জন। একই সঙ্গে এ পর্যন্ত ৬২ জন নার্সসহ ১২১ জন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জিকিত্সক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবে তারা রোগীদের চিকিত্সাসেবা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসামগ্রী বা পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্টের (পিপিই) অভাবে হাসপাতালের চিকিত্সক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ চরমে পৌঁছেছে।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের কাছে আতঙ্কে একশ্রেণির চিকিত্সক-নার্স যেতে চান না। চিকিত্সকেরা একটা ব্যবস্থাপত্র দিয়েই রুমে বসে থাকেন। ঐ ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা দিতে নার্সদের বলে দেন। হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিত্সক-নার্সরা বলেন, ‘আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসি রুমে বসে বড়ো বড়ো কথা না বলেন। হাসপাতাল ঘুরে দেখে যাক, কীভাবে আমরা দায়িত্ব পালন করছি। অথবা নিরপেক্ষ কমিটি পাঠিয়েও দেখে যেতে পারেন বিষয়টি সত্য নাকি মিথ্যা।’
শনিবার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত একজন নার্স করোনায় আক্রান্ত হন। ৬ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত মিলিনা নামক হোটেলে থেকে তিনি ডিউটি করতেন। আক্রান্তের খবর শুনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে বাসায় চলে যেতে বলেছিল। এতে তিনি রাজি না হয়ে বিষয়টি নার্সিং অধিদপ্তরকে অবহিত করেন। পরে তাকে হোটেল থেকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু তার রুমমেট কিংবা আশপাশের রুমে থাকা নার্স যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন, তারা কী করবেন? কিংবা হোটেলটি লকডাউন করা হবে কি না, সে ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। ফলে হোটেলে অবস্থানরত নার্সদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, তারা সারাদেশে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেয়েছেন যে, নিম্নমানের মাস্ক ও পিপিই সরবরাহের কারণে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা আতঙ্কিত। অনেকেই এসব মাস্ক ও পিপিই ব্যবহার করে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। তার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলার সময় চিকিৎসকদের পজিটিভ কথা বলতে বলা হয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে। স্বাচিপের ঐ কর্মকর্তা আরো বলেন, নিম্নমানের মাস্ক ও পিপিই চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মধ্যে সরবরাহের নামে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। যারা এই দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার হতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের একশ্রেণির দুর্বৃত্তের কারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। প্রধানমন্ত্রীর দুঃসাহসিক পদক্ষেপে স্বাচিপের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ জন রোগীর সিজারিয়ান অপারেশন হয়। এছাড়া ৪০ থেকে ৫০ জন রোগীর নরমাল ডেলিভারি হয়ে আসছে। এই গাইনি বিভাগের একজন চিকিত্সক বলেন, তারা মাস্ক, পিপিই ব্যবহার করার পরও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। চার জন নার্সও করোনায় আক্রান্ত। করোনায় আক্রান্ত একজন রোগী ডেলিভারি করতে আসলে তার মাধ্যমে তারা আক্রান্ত হন। নিম্নমানের পিপিই ও মাস্ক কোনো কাজে আসে না উল্লেখ করে ঐ চিকিত্সক বলেন, ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। নিম্নমানের ব্যবহারের অনুপযোগী মাস্ক ও পিপিই দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, চিকিত্সকরা সেবা দেবে। কিন্তু ন্যূনতম নিরাপত্তা কেন পাবে না?
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, তার মেডিক্যাল কলেজে সার্জারি বিভাগের চার জন চিকিত্সক করোনায় আক্রান্ত। মেডিসিন বিভাগের চিকিত্সকও সংক্রমিত। তিনি বলেন, চিকিত্সকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আমাদের কপাল খারাপ, রোগীদেরও কপাল খারাপ। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আমাদের কথা কেউ শুনে না। তিনি বলেন, আমরা রোগীদের ফেরত দিতে চাই না। তবে চিকিত্সকদের নিরাপত্তা নিয়ে সেবা দিতে হবে। ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, কেউ-ই লকডাউন মানছেন না। এতে বিপদ বাড়ছে।
এদিকে ঢাকা শিশু হাসপাতালের এক চিকিত্সক মোহাম্মদপুরে থাকেন। সম্প্রতি বাজারে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হন। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ৬ জন চিকিত্সক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে অজ্ঞানকারী, শিশু, মেডিসিন ও গাইনি বিভাগের চিকিত্সক রয়েছেন। এই হাসপাতালের চিকিত্সক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা বেশি অবহেলিত। সম্প্রতি এই হাসপাতালকে কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে করোনা রোগীদের সেবা চালু করব।
চিকিত্সকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, করোনায় চিকিত্সক-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে আমরা বিষয়টি মনিটরিং করছি। তিনি বলেন, তিনি শুধু করোনা রোগী নয়, সাধারণ রোগীদেরও সেবা দিতে হবে। তবে সবার আগে চিকিত্সক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমরা কাউকে অনিরাপদ রেখে চিকিত্সাসেবা দিতে বলব না। তবে কোনো কোনো ডাক্তার অতিরঞ্জিত করছেন। তিনি বলেন, কার্গো বিমানে চীন থেকে মাস্ক ও পিপিই এসেছে শুনেছি। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত জানি না।
১৭ সদস্যের ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ গঠন
এদিকে দেশে করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ১৭ সদস্যের একটি ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ গঠন করেছে। এই কমিটির সভাপতি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাকে। আর সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করবেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। কমিটি কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেবে। যেসব চিকিত্সক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিটি সরকারকে পরামর্শ দেবে। স্বাস্থ্যসেবা দানকারী চিকিত্সকসহ অন্যদের উত্সাহ প্রদানে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে বিষয়েও পরামর্শ দেবে। গত ২৮ মার্চ আট জন জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে সরকারি যে কমিটি করা হয়, সেই কমিটি এবং নতুন কমিটি প্রয়োজনে যে কোনো কমিটির এক বা একাধিক সদস্যের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারবে। প্রয়োজনে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্যরা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ও গ্যাস্ট্রোএন্ট্রারোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান, বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য (ভাইরোলজিস্ট) অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান, জ্যেষ্ঠ প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সনাল, জ্যেষ্ঠ প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রওশন আরা বেগম, আইসিডিডিআরবির মেটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ রিসার্চ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক শামস এল আরেফিন, জ্যেষ্ঠ অ্যানেসথিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান, জ্যেষ্ঠ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তারিকুল ইসলাম, বিএসএমএমইউর মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হুমায়ন সাত্তার, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম মোস্তফা, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. আবদুল মোহিত। বিলম্বে হলেও অবশেষে ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ গঠন হওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন চিকিত্সকেরা। তারা বলেন, এটা শুরুতে হওয়া উচিত ছিল।