ক্স বিনোদনকেন্দ্রের আড়ালে হাই সোসাইটির পতিতা ব্যবসা
ক্স জঙ্গীদের গোপন বৈঠকের নিরাপদ স্থান
ক্স বিদেশি মদ তৈরির কারখানা, পাওয়া যায় ইয়াবাসহ সব ধরণের মাদক
বিলাসবহুল বিনোদনকেন্দ্র প্রজাপতি গার্ডেনের স্থাপনা নির্মাণ ও জমি ক্রয়ের বিশাল অঙ্কের অর্থ বিএনপি নেতা ও জঙ্গীদের অর্থ যোগানদাতা মিলন কীভাবে জোগাড় করেছে-তা খতিয়ে দেখা জরুরী
নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ তথা সাতারকুলে গড়ে ওঠা প্রজাপতি গার্ডেনে পতিতাবৃত্তি, মাদকব্যবসা ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা- চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারী দলের কতিপয় নেতা ও পুলিশ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় বিএনপি নেতা মিলন প্রজাপতি গার্ডেনে অবৈধ ও অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী।
এছাড়া রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে গড়ে ওঠা বিপুলসংখ্যক বিলাসবহুল বাগানবাড়িতেও নিয়মিত মদ-জুয়ার বড় আসর বসছে। সেখানে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপও চলছে। বেশির ভাগের বাগানবাড়ির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবাজ গডফাদারদের হাতে থাকায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিতে পারছে না তবে সবাইকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গেছেন সাতারকুল এলাকার মিলনের প্রজাপতি গার্ডেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১০ বছরে গাজীপুর, কালিয়াকৈর, রূপগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী ও সাভারসহ রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছোটবড় অন্তত দুই শ বাগানবাড়ি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বেশকিছু বাগানবাড়ি বা রিসোর্ট সাধারণ মানুষের অবসর যাপন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বাদবাকি প্রায় সবগুলোতেই মদ-জুয়াসহ নানা অনৈতিক বাণিজ্য জমিয়ে তুলেছে রাজনৈতিক গডফাদাররা। মোটা অঙ্কের মাসোহারার বিনিময়ে স্থানীয় থানা পুলিশ এসব অপকর্মে পূর্ণ সহযোগিতা দিচ্ছে। এমনকি এসব অনৈতিক বিনোদনকেন্দ্রে কোনো ধরনের ঝামেলা হলে তারা নিজেরাই তা মিটিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে সেখানকার এসব অপকর্মের তথ্য এত দিন শীর্ষ প্রশাসনের অগোচরেই রয়ে গেছে।
গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, রাজনৈতিক গডফাদারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণার পর প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঢাকার উপকণ্ঠ এলাকার ছোটবড় সব ধরনের বাগানবাড়ির তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এসব বাগানবাড়ির মূল মালিক কারা কিংবা মালিকদের পর্দার আড়ালে রেখে কারা এসব বিনোদনকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন, সেখানে কোন ধরনের অতিথিদের নিয়মিত আনাগোনা এবং মদ-জুয়ার পাশাপাশি অন্য কোনো ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে কি না সে সম্পর্কে গোয়েন্দাদের বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করতে বলা হয়েছিল। এ ছাড়া এসব বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না তা-ও খুঁজে দেখার তাগিদ দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই উদ্যোগ থেমে গেছে।
গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা জানান, গাজীপুর, কালিয়াকৈর ও চন্দ্রাসহ এর আশপাশের এলাকায় অন্তত ৭৪টি বাগানবাড়ি বা রিসোর্ট রয়েছে। তবে এর বেশির ভাগই অবসর বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। এসব বাগানবাড়ির মালিকরা এ কেন্দ্রগুলো মূলত নিজেদের বিনোদনের জন্যই তৈরি করেছেন। তাদের কেউ কেউ সপ্তাহে এক দিন কিংবা দুদিন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সেখানে ঘুরতে আসেন। কোনো কোনো বাগানবাড়িতে মাসে এক-দুবার নাচগান ও মদ-জুয়ার বড় আসর জমে। তবে বাগানবাড়ির মালিকরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং এ ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
কালিয়াকৈরের বাসিন্দারা জানান, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী রাজনীতিকরা বন বিভাগের শালবনের আশপাশে স্থানীয়দের কাছ থেকে অল্প দামে ৫-১০ বিঘা জমি কেনেন। পরে তারা শালবনের বেশকিছু জায়গা দখল করে দেয়াল ঘিরে বাগানবাড়ি গড়ে তোলেন। এসব মালিকের সঙ্গে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে যোগসাজশ থাকায় সহসা কেউ তাদের ঘাঁটাতে সাহস পান না।
স্থানীয়দের ভাষ্য, বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলা রিসোর্ট বা বাগানবাড়িগুলো সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হলেও সেখানেও অতিথিদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মদ-জুয়া ও নারীর আসর বসানোর সুযোগ রয়েছে। আবার কোনো কোনো রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এসব আখড়া নিয়মিত পরিচালনা করছেন। আর এজন্য তারা স্থানীয় থানা পুলিশ, ডিবি-এসবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়মিত মাসোহারা দিচ্ছেন।
এদিকে মুন্সীগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও রূপগঞ্জে প্রজাপতি গার্ডেনসহ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বেশ কজন গডফাদারের চোখ ধাঁধানো বাগানবাড়ি রয়েছে বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে। সেখানে সুইমিং পুল, মদের বার, জুয়ার রুম ও বারবিকিউ সেন্টার তৈরি করতেই ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি কক্ষই ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার দামি আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। মদের বারের অনুমতি না থাকলেও সেখানকার ফ্রিজে লাখ লাখ টাকার বিদেশি মদ-বিয়ার মজুত রাখা হচ্ছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, পরিবহন ব্যবসার তোলা আদায়কারী, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক কারবারি ও অস্ত্রের ব্যবসা করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া অতিথিরা নিত্যনতুন নায়িকা-গায়িকা কিংবা সুন্দরী কলগার্ল নিয়ে সেখানে আসছেন। অথচ অনৈতিক এসব কার্যক্রমে বাধা দিতে গেলে খোদ পুলিশকেও বিপাকে পড়তে হচ্ছে। রাজনৈতিক দাপট দেখিয়ে পুলিশের ছোটোখাটো কর্মকর্তাকে দীর্ঘ সময় বাগানবাড়িতে আটকে রাখারও অভিযোগ পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
রাজধানীর মতিঝিল-আরামবাগ ক্লাবপাড়া এলাকা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারকৃত একাধিক জুয়াড়ি জানান, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জুয়াড়িরাই মূলত ক্লাবপাড়ার খেলোয়াড়। তারা তাদের মান অনুযায়ী বিভিন্ন ক্লাবে নিয়মিত জুয়া খেলেন। তবে বড় জুয়াড়িরা সাধারণত সেখানে যান না। তাদের আসর জমে ঢাকার বিভিন্ন দামি আবাসিক হোটেলে। আবার এদের একটি অংশ নারীসঙ্গ ও মদের নেশায় বিভোর হয়ে জুয়া খেলতে জড়ো হন তাদের নিজস্ব বাগানবাড়িতে। অনিয়মিত এসব আসর মাসে দু-চার দিন বসলেও তাতে ক্লাবপাড়ার এক মাসের চেয়ে বেশি অঙ্কের জুয়া খেলা চলে বলে দাবি করেন তারা।
সিআইডির আর্থিক গোয়েন্দারা জানান, এরই মধ্যে তারা গাজীপুর, কালিয়াকৈর, রূপগঞ্জ, সাভার, মুন্সীগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের দেড় শতাধিক ছোটবড় বাগানবাড়ির তথ্য জোগাড় করেছে। যার অন্তত ৩০টির মালিক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। এসব বাগানবাড়ি ও রিসোর্ট তৈরি করতে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা খরচ হলেও তাদের অধিকাংশের আয়কর নথিতে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। এমনকি এদের অনেকেই নির্দিষ্ট কোনো পেশায়ও জড়িত নন।
এছাড়া গডফাদারদের অনেকেই এসব বাগানবাড়ির নথিপত্রে দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনদের মালিক হিসেবে দেখিয়েছেন। তাই এ ক্ষেত্রে তারা সহজেই পার পেয়ে যাবেন। অন্যদিকে বেশকিছু বাগানবাড়ির মালিক মূলত বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। গত ১১ বছর ধরে তারা ক্ষমতায় না থাকায় তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ক্ষমতাসীন দলের গডফাদারদের দিয়ে রেখেছেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত অ্যাকশন নেয়া কঠিন হবে। তবে মিলন সবাইকে ম্যানেজ করে নিজেই পরিচালনা করছেন প্রজাপতি গার্ডেন।