রাজা সিরাজ
সতের বছর পর গ্রামের বাড়িতে এসেছে নুরু, সবকিছুই আজ অচেনা তার কাছে। মানুষগুলোকেও চিনতে পারছে না সে, তাকেও চিনতে পারছে না কেউ। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও বাড়িতে আসেনি সে, মা অসুস্থ তাই আসতে হয়েছে। সাদুল্লারচর বাজারটাও আগের মত নেই। রিকসা থেকে নামতেই হাতের ডান পাশে চোখে পড়লো একটা তোরণ, তাতে লেখা ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পপতি জুবেদ চৌধুরীর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।’
আরেকটু কাছে গিয়ে দেখলো, হ্যা, এটাইতো সেই জুবেদ আলী, এখন চৌধুরী হয়েছে, আবার শিল্পপতিও। হ্যা, নাকের কাটা দাগটা এখনো আছে, পেয়ারার মুখে দাঁতের মধ্যে আটকেছিল নাকের এক টুকরা মাংস, ওর মা বলেছিল তাকে, কবর দেয়ার সময় ওই মাংসের টুকরা দাঁতের মধ্যেই ছিল, কেউ বের করতে পারেনি। না, এই মুহর্তে আর বাড়ি যাওয়া যাবে না, লুকিয়ে থেকে ধরতে হবে জুবেদ আলীকে, দেখতে হবে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হলো সে, ওকে মারতে পারলে পেয়ারার আত্মা শান্তি পাবে, নিজে মরেও শান্তি পাবো।’ এটা ভেবেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেল নুরু।
বিকালে একটি পাজেরো গাড়ীতে করে এলো জুবেদ আলী, তার পেছনে আরো ৪টি প্রাইভেট কার। ‘জুবেদ চৌধুরীর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠলো সাদুল্লারচর বাজার, খেলার মাঠ। তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে মঞ্চে বসানো হলো। একজন মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলো, ‘আমাদের আজকের প্রধান অতিথি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট শিল্পপতি জুবেদ চৌধুরী আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন। আপনারা জানেন এবং অনেকেই দেখেছেন তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কিন্তু বাস্তবে তিনি গুপ্তচর হিসেবে শান্তি কমিটিতে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তথ্য সরবরাহ করে সহযোগিতা করেছেন। এই কাজটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, পাক সেনারা টের পেলেই তার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। কাজেই তিনি জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য কাজ করেছেন, আজকে তাকে সংবর্ধনা দিতে পেরে আমরা গর্বিত।’
কথাটা শোনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না নুরু। চিৎকার করে বললো, ‘মিছা কথা, মিছা কথা, হে আছিল রাজাকারের কমা-ার, অনেক মানুষ মারছে, আমারে রেজাকার বানাইচে, অনেক লুটতরাজ করচে, আমার বউরে ধর্ষণ কইরা মাইরা ফালাইছে’Ñ
বলতে বলতে একজন ভলান্টিয়ারের হাত থেকে লাঠিটা ছিনিয়ে দৌঁড় দিল মঞ্চের দিকে। এরপর শকুনের দল খামচে ধরলো তাকে, জ্ঞান ফিরলে বুঝলো হাসপাতালের বিছানায় আছে সে-স্যালাইন চলছে, তার হাতে হ্যা-কাপ, পায়ে শিকল। আজ বাবার কথা খুব মনে পড়ছে নুরুর, কি দুর্ব্যবহারটাই না করেছিল বাবার সাথে। চোখে ভেসে ওঠলো সেইসব স্মৃতি……..
‘কুত্তার বাইচ্চা, জন্ম দিছস, কর্ম করতে পারছ নাই, রিসকার প্যাডেল ঘুরাইতে ঘুরাইতে জীবনডা কয়লা অয়া যাইতাছে, অহন একটা চারহি পাইছি এইডাও তর সইজ্জ অয় না? চুতমারানীর পুত, পাছা দিয়া একটা গুলি করাম মুখ দিয়া বাইর করাম।’
বলতে বলতে নিজের বাপের দিকে রাইফেলটা তাক করলো নুইর্যা রাজাকার। বটি হাতে ঘর থেকে দৌঁড়ে ছুটে এলো তার মা ফুলজান বিবিÑ বটিটা ছেলের ঘাড়ের কাছে ধরে চিৎকার দিল, ‘র্ক গুলি র্ক, নাইলে একটা কুব দেয়া তর কল্লাডা মাডিত ফালায়া দেয়াম, র্ক গুলি কর।’
এবার রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে মাথাটা নিচু করে দ্রুত চলতে লাগলো নুরুÑ একটু দূরে গিয়ে আবার থামলো, পিছন ফিরে বাপের দিকে তাকিয়ে আবার বললো, ‘খালি মায়ার লাইগ্যা আইজগা বাইচ্চা গেলি, বাপের বেডা অইলে বড়পুল আইছ, মাথার কুলিডা ওড়ায়া দেয়াম।’
কথা শেষ করে দ্রুত পা চালাতে লাগলো নুরু। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নুরুর দিকে। সহজ সরল হাবাগুবা নুরু খাকি পোশাক গায়ে জড়িয়ে কেমন পাল্টে গেল সেটাই হয়তো ভাবছে প্রতিবেশিরা, ভাবছে নুরুর মাÑ বাবাও, তাই কারো মুখে কোন রা নেই। এক বাপের একমাত্র আদরের ছেলে নুর ইসলাম, সবাই ডাকতো নুরু বলে, এখন তার নাম নুইর্যা রাজাকার। বাবার নাম দারগার বাপ। পেশায় দিনমজুর। মানুষের ক্ষেত খামারে কাজ করে সংসার চলে। সম্বল শুধু বাপের ভিটেটুকু। জমাজমি যা ছিল নুরুর দাদা বিক্রি করে বসে বসে খেয়ে শেষ করে গেছে, শেষমেষ যক্ষা রোগে বিনা চিকিৎসায় মরেছে। সেসময় যার হতো যক্ষা তার হতো না রক্ষা। মা ফুলজান বিবি পুতের বউয়ের হাতের ভাত খাবে বলে অল্প বয়সেই বিয়ে করিয়েছিল নুরুকে। একটি কুড়েঘরের মাঝখানে পার্টিশন দিয়ে এক পাশে মাÑ বাবা আর অন্য পাশে বউ নিয়ে ঘুমায় নুরু। সংসারের অভাব নিয়ে প্রায় রাতেই নুরুর হাতাহাতি শুরু হয় স্ত্রীর সাথে। ঘুম ভেঙ্গে যায় দারগার বাপ আর ফুলজান বিবির। বউয়ের হাতের ভাত খেতে চেয়ে কি যন্ত্রনাইনা ডেকে এনেছে!
নুরু রিকসা চালিয়ে যা রোজগার করে তার অর্ধেকটাই শেষ করে ফেলে মদÑ গাঁজা খেয়ে। প্রথমদিকে কেবল গাঁজা সেবন করতোÑ পরে কিশোরগঞ্জের মেথরপট্টি থেকে পঁচা ভাত দিয়ে বানানো মদ গিলে আসতে শুরু করেছে। নুরুর বউ পেয়ারা বানু মদের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না। নুরু মদ পান করে ঢুকলেই পেয়ারার বমি শুরু হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে নুরু যখন স্ত্রীকে আদর করে কাছে টানতে চায় তখনই শুরু হয় ধস্তাধস্তি। পার্টিশনের ওপার থেকে মা বাবা ধস্তাধস্তির শব্দে জেগে গেলেও দাঁত কামড়ে শুয়ে থাকে। অভাবের সংসার, এর মাঝে ছেলের এধরনের আচরণে খুবই অসন্তুষ্ট তারা, ভাল করতে গিয়ে হয়ে গেছে উল্টো। তারপরেও সুখেÑ দুঃখে কেটে যাচ্ছিল দিন।
এরই মাঝে মাসখানেক আগে পাকিস্তান বাহিনী এসেছে কিশোরগঞ্জে। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ ফেরি দিয়ে পার হয়ে কিশোরগঞ্জে আসতে হয়। কিশোরগঞ্জে আসার একমাত্র পথ এটি। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে তারের ঘাট গাঙÑ এর উপর একটি পাকা ব্রিজ ছিল, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যাতে কিশোরগঞ্জে আসতে না পারে সেজন্য মুক্তি সেনারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে ব্রিজটি। কিন্তু রাতের বেলা হেলিকপ্টার দিয়ে কিশোরগঞ্জের ষ্টেডিয়ামে নেমেছে হানাদার বাহিনী। পরদিন থেকেই শুরু করেছে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ। মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। যেসব এলাকায় চলাচলের রাস্তা নেই, পায়ে হেঁটে বা নৌকা দিয়ে যেতে হয় সেসব এলাকায় আত্মীয়Ñ স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকেই।
নুরুদের গ্রামের পূবদিকে রয়েছে চাড়ালিয়া নামক বিল, সেই বিলের পরে আছে আরেকটি বড় বিল, নাম ভাস্করকিলা। ভাস্করকিলা বিলের পরেই মহিনন্দ গ্রাম। নৌকা ছাড়া মহিনন্দ গ্রামে যাবার আর কোন রাস্তা নেই। মহিনন্দ গ্রামেই বিয়ে করেছে নুরু। পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচারের কথা শোনে নুরুর স্ত্রী পেয়ারা বানু চলে গেছে বাপের বাড়িতে। নুরুও গিয়েছিল বউয়ের সাথে কিন্তু ওদেরও অভাবের সংসার, পরের বাড়িতে কতদিন বসে খাওয়া যায়? তাই বউকে রেখে বাড়িতে চলে এসেছে। তাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই সাদুল্লারচর বাজার, সেই বাজারের উপর দিয়েই চলে গেছে কিশোরগঞ্জÑ ময়মনসিংহ সড়ক। সাদুল্লারচর বাজার থেকে চার মাইল দূরে কিশোরগঞ্জ শহর, সাদুল্লারচর থেকে কিশোরগঞ্জ সড়কে রিকসা চালিয়ে যা রোজগার করতো তা দিয়েই চলতো নুরুর সংসার।
শহরে পাকিস্তানী মিলিটারী আসার পর আর বাজারে যায়নি নুরু। মদÑ গাঁজা তো দূরের কথা বিড়িও খেতে পায়নি, তামাক খেয়ে কেটেছে দিনগুলো। তামাকও শেষ, তাই সাহস করে বাজারের দিকে রওনা দিল। হানাদার বাহিনী আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অত্যাচার চালালেও এই গ্রামে আসেনি এখনো, সাদুল্লার চর বাজারেও কোন তা-ব চালায়নি। তাই সাহস করে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে করতে বাজারে গিয়ে পৌঁছলো নুরু। সমস্ত বাজার জুড়েই ভীতিকর অবস্থা, মাত্র দু’টা চায়ের দোকান খোলা আছে। বাজারে ঢুকেই চোখে পড়লো সামছু মিয়ার দোকান, সামনের টুলে বসে চা পান করছে বড়বাগ গ্রামের দুই মাতব্বর। নুরু তাদের পাশে বসে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। কারো মুখেই কোন কথা নেই, চা শেষ করে এক প্যাকেট বিড়ি কিনে বাড়ির দিকে রওনা দিল নুরু।
এসময় একটি রিকসায় করে তার সামনে এসে দাঁড়াল বড়বাগ গ্রামের বড় মাতুব্বর জুবেদ আলী, ‘কিরে নুরা কেমন আছিস?’
‘বালা আছি কাকা, আফনে কেমন আছুইন?’ কাচুমাচু হয়ে বললো নুরু।
‘চল আমার সাথে চল, তোরে একটা বালা চাকরি দিয়াম।’
Ñ কি চারহি কাকা?
Ñ ‘আগে চল আমার লগে, তোর জীবনের মোড় ঘুরায়া দিয়াম, ওঠ্ রিকসায় ওঠ্।’
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনেকটা জোর করেই রিকসায় তুললো নুরুকে। রিকসা চলতে লাগলো কিশোরগঞ্জ শহরের দিকে।
জুবেদ আলী আবার বলতে শুরু করলো, ‘শোন, পাক বাহিনীর সাথে আমার কথা অইছে, তারা আমারে উত্তর অঞ্চলের শান্তি কমিটির হেড বানায়া দিছে, অহন আমি যা কইবাম হেইডাই অইবো, যারে খুশি আমি অহন মারতে পারি, জীবনে সুযোগ বার বার আইয়ে না, এই সুযোগে যা পারি কামায়া নিয়াম, তোরে রেজাকার বাহিনীতে ঢুকায়া দেয়াম, মাসে মাসে বেতন পাইবি, বইয়া বইয়া খাইবি, সুযোগমত একটা কাম করবি তারপর সারাজীবন বইয়া বইয়া খাইবি।’
Ñ ‘আমার ডর লাগে কাকা, মুক্তিরা যদি দেশ স্বাধীন কইরা ফালায়, তখন কি অইবো?’
Ñ ‘তুই বেডা আসলে একটা ফাডা? মুক্তিরা দেশ স্বাধীন করবো এইডা তুই ভাবলি কেমনে? নয় মণ ঘিও অইবো না, রাধাও নাচবো না, বুঝলি?’
Ñ ‘কিন্তু আমারতো কোনো টেনিং নাই, কেমনে কি?’
Ñ ‘এসব লইয়া তর ভাবতে অইবো না, যা হরার আমি হরাম।’
রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের পর আজই প্রথম বাড়িতে এসেছে নুরু, মাÑ বাবার খাবারÑ দাবারসহ অনেক কাপড়চোপরও নিয়ে এসেছে। নুরুর এভাবে আগমন দেখে অবাক হলো তার বাবাÑ মা। তারা ভেবেছিল নুরু হয়তো শ^শুরবাড়িতে চলে গেছে।
নুরুর মা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘বাজান তুই কি রেজাকার বাহিনীতে যোগ দিছস?’
কোন উত্তর দেয় না নুরু। নুরুর বাবা দূর থেকে চিৎকার করে বললো, ‘তর সাহসতো কম না, তুই লুডের মাল লয়া আমার বাড়িত আইছস, আমি না খায়া মরলেওতো এসব লুডের মাল আমার গলা দিয়া নামতো না, এইগুলা লয়া বাইর অইয়া যা আমার বাড়িত্তে, আমি তর মুখ দেখতাম চাই না।’
বাবার কথায় ক্ষেপে গিয়েই তার মাথার খুলি উড়িয়ে দেবার হুমকি দিল নুরু। এরপর দ্রুত চলে গেল ক্যাম্পের দিকে।
রাজাকার ক্যাম্পে গিয়েও সারাদিনই মেজাজটা বিগড়ে থাকে নুরুর। বিকালে জুবেদ আলী আরো দুই যুবককে নিয়ে এসে ভর্তি করালো রাজাকার বাহিনীতে।
নুরুর মুখ ভার দেখে জিজ্ঞেস করলো ‘ কিরে মন খারাপ কেরে? বুঝছি, বউ বাপের বাইত, ঠিক না?’
নুরুকে নিরুত্তর দেখে জুবেদ আলী আবার বললো, ‘যা একদিনের ছুডি নিয়া যায়া বউরে বাড়িত লইয়া আয়, তাইলেই মন ঠিক অয়া যাইবো, অহনতো আর কোনো সমস্যা নাই।’
মাথা নিচু করে লজ্জিত কন্ঠে নুরু বললো, ‘ছুডিতো দিতে চায় না কাকা।’
Ñ ‘আরে দুর, আমি আছি না? তুই চিন্তা করছ কেরে? আয় আমার সাথে, ছুডি লয়া দিতাছি।’
জুবেদ আলীর কথায় কমা-ার নুরুকে দুই দিনের ছুটি দিল। নুরু সোজা চলে গেল শ^শুরবাড়িতে, সাথে নিল বিস্কুট, ছাতু, পাউডার দুধ ও লুট করে পাওয়া কিছু কাপড়। নুরু রাজাকারের পোশাক পড়েই চলে গেল শ^শুরবাড়িতে। প্রথমে সবাই ভয় পেয়ে পালাতে থাকলো।
নুরু চিৎকার করে বললো, ‘ভয় পাইয়েন না, আমি পেয়ারা বানুর জামাই।’
এবার ঘরের ভিতর লুকিয়ে থাকা পেয়ারা বানু বেরিয়ে নুরুর কাছে এসে বললো, ‘ও মায়াগো তুমি এইতা কিতা পোশাক পিনছ?’
নুরু বউয়ের হাত ধরে ঘরের ভিতর ঢুকে বললো, ‘আমি রেজাকার বাহিনীত যোগ দিছি, অহন আর আমরার অভাব থাকতো না।’
সে প্রথমে বউয়ের শরীরে একটা শাড়ি পড়িয়ে দিল এরপর একটা শাড়ি ও একটা লুঙ্গি বউয়ে হাতে দিয়ে বললো, ‘যাও এগুলা আব্বা আর আম্মারে দিয়া আও।’
পেয়ারা কাপড় নিয়ে মাÑ বাবার কাছে যেতে থাকলে তাকে থামিয়ে দিল নুরু, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও কিছু খাবার নিয়ে যাও’ বলে ব্যাগ থেকে ছাতু বের করে বললো, ‘জান এইগুলার নাম কি? এইগুলা অইল ছাতু, খাইতেও মজা, আবার অল্প খাইলেই ক্ষিধা চইল্লা যায়।’ তারপর আরেকটা প্যাকেট বের করে বললো, ‘এইগুলা চিনো? এইগুলার নাম অইল বিলাতি দুধ, হুদাও খাওয়ন যায় আবার জাল দিয়া দুধ বানায়াও খাওন যায়, যাও এগুলাও নিয়া যাও।’
বাজারে গিয়ে মাছÑ মাংসও কিনে আনলো নুরু। রাতে শ^শুরবাড়ির সবাইকে নিয়ে একসাথে খাওয়াÑ দাওয়া করলো। পরদিন সকালে বউকে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে এলো। নুরুকে আসতে দেখেই তার বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, মা এগিয়ে এসে বউকে হাত ধরে নিয়ে গেল ঘরের ভিতর।
নুরু জানতে চাইল ‘ ওই মা হেইদিনের খাওনগুলো কি ফালায়া দিছিলা নাকি খাইছিলা?’
‘আমিতো খাইছি বাবা, কিন্তু তর বাপেরে খাওয়াইতে পারি নাই।’ অনেকটা অপরাধীর মতোই জবাব দিল নুরুর মা।
নুরু রাগত সুরেই বললো, ‘শালার বুইড়া! অহনও তেজ কমে না, খালি মাইনষে মন্দ কইবো দেইখ্যা, নাইলে কোনদিন মাইরা মাডিত পুইত্যা ফালাইতাম!’
নুরুর ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে মিনতি করে নুরুর মা বললো, ‘ছিঃ বাজান! এসব কথা কয় না, আল্লায় গুনা দিবো।’
বউকে বাড়িতে রেখে নুরু বাজারে গিয়ে চাল-ডালসহ সবকিছু কিনে আনলো। রাতে নুরুর বাবা আর বাড়িতে আসেনি। ওরা তিনজন একসাথে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন সকালে নুরু চলে গেল রাজাকার ক্যাম্পে, যাবার সময় বলে গেল, ‘কোনো চিন্তা কইরো না বউ, হপ্তায় একদিন ছুডি লয়া বাড়িত আয়া আডÑ বাজার কইরা দিয়া যায়াম, আর যেদিন বড় দান মারবাম হেইদিন রাইতের বেলা আয়া মালামাল লুগায়া তইয়া যাইবাম।’
দুইদিন পরেই গভীর রাতে ঘরের দরজায় থাপার শব্দ এবং নুরুর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল পেয়ারা বানুর। দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকলো নুরু তার পেছনে জুবেদ আলী। নুরু পরিচয় করিয়ে দিল ‘হোন বউ, উনি অইলেন জুবেদ আলী কাকা, এই এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, ওনার দয়াতেই চারহিডা পাইছি, কোনু বিফদ আফদ অইলে সোজা কাকার কাছে চইলা যাইবা, বড়বাগ গেরামে গেয়া জুবেদ আলী মাতব্বরের নাম কইলে সবাই বাড়ি দেহায়া দিবো, অহন কোদালডা আনো, এই ব্যাগের মইধ্যে অনেক সোনদানা আছে, এইগুলা চকির নীচে গাতা কইরা লুগায়া রাখবাম, কেউ যেন টের না পায়, এই কাকা আয়া চাইলে দিয়া দিবা, ঠিক আছে?’
‘হ ঠিক আছে’ মাথা কাত করে সায় দিয়ে জানতে চাইল পেয়ারা বানু
Ñত এইগুলা কইত্তন আনছ?
Ñকইত্তন আনছি হেইডা হুইন্না তুই কি হরবি? এক মালাওনের বাড়ি লুট হরছি, কেউওে কইচ না, তর ফেডে ত কথা অজম অয় না।
চৌকির নীচে গর্ত করে সোনাদানা ভর্তি ব্যাগ লুকিয়ে রেখে বিদায় নিল জুবেদ আলী ও নুরু।
বেশ ফুরফুরে মেজাজেই কেটে গেছে কয়েকটা মাস। এর মাঝেই পোয়াতি হয়েছে পেয়ারা বানু, নুরুর মা’র মনে খুবই আনন্দ, নাতিকে কোলে নিয়ে খেলা করবে, পাড়ায় ঘুরে বেড়াবে, আরো কত কি?
কিন্তু নুরুর বাবা বলে অন্য কথা, ‘ওই সন্তান দুনিয়াত আইলে মাইনষে কইবো রাজাকারের সন্তান, আমারে কইবো রাজাকারের সন্তানের দাদা, এইসব কথা হুনার আগে আমার মরণ ভালা।’
নুরুর মা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ছিঃ এমন কথা মুখে আনতে নাই, পেডের সন্তানের কি দোষ, হে কি হের বাপেরে রেজাকার অইতে কইছে?’
নুরুর স্ত্রী কোন কথা বলে না, মুচকি হেসে ঘরের ভিতর চলে যায়। কিন্তু দিন দিন টেনশন বাড়তে থাকে থাকে নুরু ও জুবেদ আলীর, একের পর এক মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের খবর শোনে কেঁপে ওঠে তাদের আত্মা, ‘যদি দেশ স্বাধীন অয়া যায়, তাইলে আমরার কি অইবো? যত দোষ ওই মালাওনের বাচ্চারার, ওরাই টেনিং দেয়া, সৈন্য দেয়া এই অবস্থা হরছে।’
জুবেদ আলীর কথায় সায় দেয় নুরু, ‘হ চাচা, ঠিহই কইছেন, সব দোষ ওই মালাওনের বাচ্চারার।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, একটা ছোট রেডিও হাতে নিয়ে দৌঁড়ে বাড়ির ওঠানে এসে চিৎকার করতে লাগলো দারগার বাপ, ‘দেশ স্বাধীন, সবাই শোন, দেশ স্বাধীন অয়া গেছে, পাকÑ হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে, হে হে হে কইছিলাম না, দেশ স্বাধীন অইবো, দেখ আমার কথাই ঠিক।’
পেয়ারা বেগমের পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠলো, বুক ধরফর করতে লাগলো, কি একটা বস্তু যেন তার পায়ের আঙ্গুল দিয়ে ঢুকে মাথা দিয়ে বের হয়ে গেল। নুরুর মা দৌঁড়ে স্বামীর কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জানতে চাইল, ‘কিগো অহন আমার পোলার কি অইবো? হের কোন খবর পাইছ?’
Ñ ‘কি আর অইবো, গুলি খায়া মরবো, কইছিল না আমারে গুলি করবো? অহন হেরে পাইলে আমি দুইডা আত কাইট্টা নেয়া সাদুল্লার বাজারে ভিক্ষার থালি দেয়া বয়াইয়া দেয়াম।’ ক্ষেপে গিয়ে জবাব দিল নুরুর বাবা।
পাশ থেকে নুরুর চাচাত ভাই বাবলু বললো, ‘কিশোরগঞ্জ অহনও স্বাধীন অয় নাই, বিভিন্ন এলাকা থাইক্কা মুক্তিÑ সেনারা কিশোরগঞ্জের চাইরদিকে ঘেরাও হরতাছে, একলগে হামলা চালাইবো।’
ওদিকে কিশোরগঞ্জ থেকে পাকিস্তানী সেনারা আগেই পালিয়েছে, শহর দখলে রেখেছে রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যরা। তারা আত্মসমর্পণ করবে না, যুদ্ধ করে মরবে বলে পণ করেছে।
গাইটাল ক্যাম্পে চিন্তামগ্ন দুই চাচাÑ ভাতিজা, ‘অহন কি হরবি নুরু, পরিস্থিতিতো খুব খারাপ মনে অইতাছে?’
Ñ‘চলেন পালায়া যাই’Ñ
Ñ‘কই যাবি? সবইতো মুক্তিগো দহলে’Ñ
Ñ‘চলেন সাদা পোশাকে গভীর রাইতে ঢাহা পলায়া গেয়া মুক্তি সেনাগো লগে মিশ্যা যাই।’
Ñ‘এইডা খারাপ কছ নাই, এক কাম কর, তুই গভীর রাইতে পায়খানায় গেয়া পিছন দেয়া পলায়া যাবি, আর তোর বাড়িত গেয়া আমি তোর বউরে কিছু ট্যাহা দেয়া বাপের বাড়িত ফাডায়া দেয়া সোনাদানার বেগডা লয়া ঢাহা যায়ামগা, তুই তেজগাঁও রেল ইষ্টিশনের আশেপাশেই থাকবি, আমি তোরে খুইজ্জা বাইর করাম, পরে একসাথে একটা বাসা নেয়া ব্যবসাÑ বাণিজ্য শুরু করাম। পরে পরিস্থিতি ঠা-া অইলে দেশে আয়াম, গোপনে বাড়িত টেহা পাডায়াম, এইডাই শেষ কথা, অহন সময় নষ্ট করন যাইবো না, চল।’
Ñ‘আমিও আফনের লগে যাই চাচা? পোয়াতি বউডারে দেখতে খুব মন চাইতাছে’…….
Ñ‘আরে না না, তোরে দেখলে তোর বাপেই মুক্তি ডাইক্কা ধরায়া দিবো, অহন মাথা গরম হরলে চলতো না, মাথা ঠা-া রাইখ্যা কাম করতে অইবো।’
রাত ১২টা পেরিয়েছে, হাল্কা শীতও পড়েছে, জুবেদ আলী গায়ে চাদর মুড়িয়ে দুই সহযোগীকে নিয়ে ঢুকে পড়লো নুরুর ঘরে।
Ñ‘বউ, কাপড়চোপড় ঘাট্টি বাইন্ধা তাড়াতাড়ি চল আমরার সাথে, আমি সোনার ব্যাগডা বাইর করতে করতে তুমি রেডি অয়া পড়।’
Ñ ‘কই যামু চাচাজান? আফনের ভাতিজা কই?’
Ñ ‘হেরে তোমার বাপের বাইত পাডায়া দিছি, গেলেই দেখতে পারবা, তোমারেও আমরা তোমার বাপের বাইত দেয়া পলায়া যায়ামগা।’
বাড়ি থেকে বের হয়ে দ্রুত পা চালাতে থাকে ওরা, চাড়ালিয়া বিলের নির্জণ স্থানে আসার পর পেয়ারা বানুর হাতটা ধরে থামায় রজব আলী, ‘এত জুরে জুরে আটতাছ কেরে, আমার মেন্নত লাগছে, বস একটু জিরায়া লই।’ হাত ধরে টেনে পেয়ারা বানুকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে দেয়।
পেয়ারা নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে চালাতে বললো, ‘এইডা কি করেন চাচাজান, আফনিতো আমার বাপের মতো।’
এবার জেগে ওঠে জুবেদ আলীর পশু প্রবৃত্তি, ‘দূর বেডি! মনে কর বাপচাচা একটা মাইনষের নাম।’ বলে মুখটা নিয়ে যায় পেয়ারার ঠোঁটের কাছে, পেয়ারা আর সময় নষ্ট না করে জুবেদ আলীর নাকে দাঁত বসিয়ে দেয়, নাকের নরম অংশ কেটে চলে যায় তার মুখের ভিতর, দৌঁড়ে পালাতে চেষ্টা করে সে।
চিৎকার দিয়ে ওঠে জুবেদ আলী, ‘মাইরালছেরেÑ মাইরালছে, চুতমারানী নডির ঝি আমারে মাইরালছে, ধর খানকি মাগিরে ধর, ধর।’
জুবেদ আলীর দুই সহযোগী ধরে ফেলে পেয়ারাকে, ওদের নির্মমতায় মুহূর্তেই পেয়ারার প্রাণবায়ূ বেরিয়ে যায়। নিথর দেহের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় তিন নরপশু। এরপর নীলগঞ্জ রেল ষ্টেশনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ওরা। জুবেদ আলীর নাক থেকে তখনো রক্ত ঝরছে। এক রাজাকার বললো
Ñচাচা আফনের শইল্লেতো অহনও রক্তে ভরা, মাইনষে দেখলেতো সন্দেহ করবো!
Ñ হ, তাইতো দেকতাছি, তো এইডি কার রক্ত? আমার না ওই মাইয়া মাইনষের?
Ñকার রক্ত কেমনে কইতাম! রক্ত ত সবারই এক রহম। রক্ত দেইখ্যাতো মানুষ চিনন যায় না। কোনডা হিন্দু, কোনডা মুসলমান, কোনডা বালা কোনডা খারাপ, কোনডা মুক্তি কোনডা রেজাকার আর কোনডা পুরুষ কোনডা মাইয়া মানুষ কিছুইতো বুঝন যায় না। তয় আফনের নাক থাইক্কা কইলাম অহনও রক্ত পড়তাছে, একবাওে টাটকা রক্ত।
Ñ একটু কাছে আয়া দেখ দেহি কতটুহু কাটছে? রাজাকার জুবেদ আলীর নাকের কাছে লাইটের আলো ফেলে বললো
Ñচাচা, নাকের সামনেতো একটা গাতা অয়া গেছেগা, মাংসডা ছিড়্যা নিছে। সারাজীবনতো একটা দাগ অয়া থাকবো।
Ñ হেইডা পরে দেহন যাইবো, অহন রক্ত বন্ধ হরনের ব্যবস্থা কর। এক রাজাকার দুর্বা ঘাস চিবিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল। জুবেদ আলী গায়ের চাদর দিয়ে শরীরটা মুছে চাদরটা ফেলে দিল। হাটতে হাটতে চলে এলো নীলগঞ্জ রেল ষ্টেশনে। ষ্টেশন মাষ্টার জানালো ‘আজ কোন গাড়ি আসবে না। জুবেদ আলী বললো
Ñ চল আমরা মমিসিংয়ের দিকে চলে যাই। মমিসিং যাইতে পারলে ঢাহা যাওনের একটা বেবস্থা অইবোই। জুবেদ আলীর কথায় রেল লাইন ধরে হাটতে লাগলো তিনজন।
পরদিন সকালে এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়লো ‘ চাড়াইল্লা বিলের পুলের নিচে একটা মাইয়া মাইনষের লেংডা লাশ পইরা রইছে। রক্তে শরীল লাল অইয়া রইছে।’ খবর পেয়ে নুরুর মা বাবা ঘটনাস্থলে গিয়ে শনাক্ত করে নুরুর স্ত্রী পেয়ারা বানুর লাশ। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো নুরুর মা। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না নুরুর বাবাও। রাতে কিছুই টের পায়নি তারা। সকালে পেয়ারাকে দেখতে না পেয়ে ভেবেছিল- হয়তো নুরু গভীর রাতে এসে বউকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কান্নাকাটি শেষে লাশ নিয়ে এলো বাড়িতে। লাশের পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল পেয়ারার পড়নের শাড়ির ছিন্ন ভিন্ন অংশ। তা দিয়েই পেয়ারার লজ্জাস্থান ঢেকে লাশ নিয়ে বাড়িতে এলো। আত্মীয় স্বজনসহ সবাইকে খবর পাঠানো হলো। নুরুর মা কাঁদতে কাঁদতে বললো-
Ñ দেহ না, নুরুরে একটা খবর দেওন যায়নি, শেষমেষ বউডারে একটু চহের দেহা দেহুক।
Ñ অহন ওইদিকে যাওন যাইবো না, মুক্তিবাহিনীরা রাজাকার ক্যাম্প ঘির্যা রাখছে, যেকোন সময় হামলা চালাইবো।’ আস্তে করে চোখের জল মুছতে মুছতে বললো নুরুর বাবা। আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো নুরুর মা। খবর পেয়ে চলে এলো মজি বুবাই। এলাকার সকল মৃত মেয়ে মানুষের গোসল করায় মজি বুবাই। তাকে খবর দিতে হয় না, সে খবর পেয়েই চলে আসে। এলাকা সকল মৃত মেয়ে মানুষের গোসল করানো আর গর্ভবতী নারীদের সন্তান প্রসবের কাজটি চল্লিশোর্ধ মজি বুবাই করে। এলাকার মেয়ে মর্জিনা মা বাবার একমাত্র সন্তান ছিল। বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামে। দুই মেয়ে আর দুই ছেলে জন্ম দিয়ে স্বামী মারা গেছে টিবি রোগে। এরপর সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে এসেছে। ইতিমধ্যে তার মা বাবাও ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরেই সময় কাটে মর্জিনার। মর্জিনা নামটা সংক্ষিপ্ত করে সবাই তাকে মজি বুবাই বলে ডাকে। মজি বুবাই এসেই গোসলের আয়োজন শুরু ্করলো। কাফনের কাপড় কিনে আনতে বেরিয়ে গেল নুরুর বাবা। লোকজন আসার পর ওঠানে ধারি দিয়ে বেড়া দিয়ে তার ভিতরে লাশ নিয়ে গোসল করাতে শুরু করলো মজি বুবাই। কিছুক্ষন পর বেরিয়ে এসে নুরুর মা’র কানে কানে কিছু একটা বলার পর নুরুর মা ভিতরে গেল। লাশের ঠোট ফাঁক করে দেখে বললো-
Ñ সত্যইতো, দাঁতের মইধ্যে কি যেন একটা বাইজ্যা রইছে। রাহ একটা চাক্কু লইয়া আই।’ ঘর থেকে একটা ছোট চাকু নিয়ে গিয়ে দাঁত থেকে আটকে থাকা দ্রব্যটা বের করে হাতের তালুতে নিয়ে বললো-
Ñ এইডাতো মনে অয় মাইনষের শইল্লের চামড়ার টুরহা! আহারে বউডা আমার বাঁচনের লাইগ্যা কত চেরেষ্টাইনা হরছে।’ আবার বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো নুরুর মা। মজি বুবাই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো-
Ñ মুর্দার কাছে বইয়া কানলে মুর্দার আত্মায় কষ্ট পায়। যাও দোয়া দরূদ পড় গিয়া আত্মাডা একটু শান্তি পাউক।’ বিকালে যথা নিয়মে পেয়ারার লাশ দাফন করা হলো। সন্ধ্যায় খবর এলো কিশোরগঞ্জ স্বাধীন হয়েছে। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করেছে। বিভিন্ন শতশত মানুষ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে পতাকা হাতে ছুটে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের দিকে। তাদের সাথে গেল নুরুর বাবাও। অন্তত ছেলের লাশটা যদি একটু দেখা যায়। কিন্তু না, ছেলের লাশ খোঁজে পায়নি দারগার বাপ। বিজয় উল্লাসের সাথে লুটপাটের দৃশ্য দেখে আবার ভারাক্রান্ত হয়েছে তার মন। বেদনাহত মন নিয়েই ফিরে এসেছে বাড়িতে। তার মুখ দেখেই নুরুর মা বুঝতে পেরেছিল ‘খবর ভাল না।’ তবও জিজ্ঞেস করলো
Ñ পাইছিলা পোলাডারে?
Ñ না পাই নাই।
Ñ লাশটাও পাইলা না? লাশটা পাইলে বউয়ের লগেই মাডি দিতাম।
Ñ না, অনেক খুঁজছি, অনেক। যারা ধরা পড়ছে হেগোর মধ্যেও নাই। মনে অয় পলাইতে পারছে।
নুরু রাজাকার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বহু কষ্টে পৌঁছেছে ঢাকায়। পায়ে হেটে, রিকসায় চড়ে এবং বেবিট্যাক্সি দিয়ে ঢাকা পৌঁছতে তার তিনদিন সময় লেগেছে। তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তিতে একটা খুপরি ভাড়া নিয়ে তাতে বাস করছে। বহুবার তেজগাঁও রেল ষ্টেশনে গিয়ে জুবেদ আলীর জন্য অপেক্ষা করেছে। কিন্তু জুবেদ আলীর দেখা পায়নি। অবশেষে আবার রিকসা চালানো শুরু করেছে। পেয়ারা বানুর গর্ভের সন্তানের বয়স নয় মাস পুর্ণ হবার পর একদিন গভীর রাতে বাড়িতে এসেছিল কিন্তু সব খবর শোনে কাঁদতে কাঁদতে রাতেই ঢাকায় চলে গিয়েছিল। সতের বছর পরে নুরু এবার প্রকাশ্যে গ্রামে এলেও এর আগে মাকে দেখার জন্য গোপনে এসেছে বহুবার। কেউ টের পায়নি। ভাবতে ভাবতে আবার চোখ বুঁজলো নুরু। ঘুমালো না জ্ঞান হারালো বুঝা গেল না। গভীর রাতে থানার ওসি ও কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে এলো জুবেদ আলী। সরকারী দলের কয়েকজন নেতাও এসেছিল তার সাথে। নেতাদেরকে হাসপাতালের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে পুলিশ নিয়ে ভিতরে এসেছে জুবেদ আলী। নুরু তখন গভীর ঘুমে। জুবেদ আলী নুরুর মাথার কাছে গিয়ে নুরুর দিকে তাকিয়ে বললো-
Ñ এতদিন কোথায় ছিল এই রাজাকারটা? আপনারা কোন খোঁজ পাননি ওসি সাহেব?
Ñ না স্যার, ও তো দেশে আসে না।’ জুবেদ আলীর গলার আওয়াজ শোনে ঘুম ভেঙ্গে গেল নুরুর। জুবেদ আলীকে তার মাথার পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠলো-
Ñ ওনাকে ধরুন ওসি সাব, ওনিই বড় রাজাকার। আমারে রাজাকার বানাইছে, আমার গর্ভবতী বউরে ধর্ষণ কইরা মাইরা ফালাইছে। আমরা দু’জনেইতো রাজাকার ছিলাম। দুইজনে একসাথে অনেক মাইনষের ধন-সম্পদ লুটপাট করছি। অহন সে মুক্তিযোদ্ধা অইলো কেমনে? ওনিই বড় রাজাকার। আফনের পিস্তলডা আমারে দেন ওসি সাব, আমি ওরে একটা গুলি কইরা পরাণডা জুড়াই। আর নাইলে আমারে একটু ছাইড়া দেন-ওরে গলা টিপ্যা মাইরা আমার বউয়ের পেডের সন্তানের আত্মাডারে একটু শান্তি দেই। আমার বউয়ের আত্মাডারে একটু শান্তি দিতে পারলে মইরাও শান্তি পায়াম।’ হাতে হ্যা-কাপ পায়ে শিকল নিয়েই নুরু জুবেদ আলীর দিকে তেড়ে যাবার চেষ্টা করলো। ওসির ইশারায় একজন পুলিশ কনস্টেবল এসে নুরুর মুখ চেপে ধরলো। জুবেদ আলী ওসির হাত ধরে তাকে একটি কোণায় নিয়ে গেল। ওসির হাতে পাঁচ’শ টাকার নোটের দুইটা বান্ডিল গুঁজে দিয়ে কানে কানে বললো
Ñ সুযোগমতো খালাস করে দিয়েন। ভাইরাস বাঁচিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে ক্যান্সার হতে পারে।’ ওসি সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে জুবেদ আলী রাতেই দলবল নিয়ে ঢাকায় চলে গেল। পরদিন সকালে খবর-‘এলো রাতে হার্ট এটাকে মারা গেছে নুরু।’ সাদুল্লার চর গ্রামের লোকজন নুরুর লাশ এনে দাফন করলো পেয়ারা বানুর কবরের পাশে।