লি কড়িগ্রাম-এর ওয়াল থেকে
(১)
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ছয়জন ডাক্তারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। টেলিভিশনে যেটা দেখেছি, এই ছয়জনের চারজন কর্মস্থলে ক্রমাগত অনুপস্থিত থেকেছেন আর দুইজন করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছেন। ওদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলি সত্যি কিনা জানিনা। ওদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে যে এর পর ওদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে, ওদেরকে সুযোগ দেওয়া হবে যাতে করে এই ডাক্তার সাহেবরা তাদের বক্তব্য পেশ করতে পারেন এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন। সেখানে কি হয় সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবুও ধরে নিলাম এইসব অভিযোগ সত্যি আছে।
এই অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাইলে আপনি এই ডাক্তার সাহেবদেরকে কি বলবেন? কাপুরুষ! দায়িত্বজ্ঞানহীন! মেরুদণ্ডহীন! স্বার্থপর! আমি দেখেছি করোনার চিকিৎসা করতে আপত্তি জানাচ্ছেন এইরকম ডাক্তার সাহেবদেরকে লোকে এইরকম নানাপ্রকার বিশেষণে বর্ণনা করছেন। এইসব বিশেষণ হয়তো নিতান্ত বাহুল্যও নয়। কেননা যে ডাক্তার সাহেব সরকারের চাকুরী নিয়েছেন, প্রতি মাসে বেতন নিয়েছেন, সমাজের সম্মান গ্রহণ করেছেন- হয়তো এই ডাক্তারি ডিগ্রী এবং সরকারি চাকুরী দেখিয়ে বিবাহও করেছেন।
এখন যখন এমন একটা দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়েছে যেটা তার পেশাগত কাজেরই অংশ- তিনি সুবিধামতো বলতে পারেন না যে তিনি এই দায়িত্ব পালন করবেন না। ঝুঁকি আছে। হয়তো একটু বেশিইই আছে। কিন্তু সে তো আপানর পেশাগত ঝুঁকিই। আপনি পেশাগত সকল সুবিধা নিবেন আর ঝুঁকি আসলে পালাবেন, তাইলে তো আর সম্মান দাবী করতে পারেন না।
আপনি ডাক্তার হতে চেয়েছেন, তারজন্যে হাজার ছেলেমেয়ের সাথে প্রতিযোগিতা করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। পেশাটা ভাল লেগেছে বলেই না প্রতিযোগিতা করেছেন। কেন ভাল লেগেছে আপনার সেটা আপনিই জানেন- সাধারণভাবে আমরা যেটা দেখি যে এই পেশায় টাকাপয়সা ভাল পাওয়া যায়, সম্মান ভাল পাওয়া যায় এইসব কারণেই ছেলেমেয়েরা এই পেশায় যেতে চায়। অনেকে মানব সেবার মহান আদর্শের কথাও বলেন। টাকা সম্মান এবং মহান আদর্শ যাইই বলেন না কেন এইসবের সাথে একটা দায়িত্বও থাকে। এইগুলি এমনি এমনিই পাওয়া যায় না। এতদিন অর্থ সম্মান ইত্যাদি সব ভোগ করেছেন, এখন যখন জাতীয় জরুরী পরিস্থিতি হয়েছে দায়িত্ব ছেড়ে পালাবেন, তাইলে আপনাকে কি বলা উচিৎ? লোভী কুকুর! নাকি নেমকহারাম!
অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাইলে আমার দাবী থাকবে ওদেরকে যেন শুধু চাকরী থেকে বের করে দিয়েই শাস্তি শেষ না হয়। ওদের প্র্যাকটিসের লাইসেন্সও কেড়ে নেওয়া হোক। এইরকম লোভী নেমকহারাম লোকজন চিকিৎসা পেশায় থাকুক এটা দেশের মানুষের জন্যে নিরাপদ নয়। এইসব স্বার্থপর লোকের হাতে দেশের মানুষের প্রাণের দায়িত্ব তুলে দেওয়া কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
(২)
এইখানে আরেকটা জরুরী প্রশ্নেরও আলোচনা করা দরকার। এই যে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে লেখাপড়া শিখাচ্ছি, যা কিছু শিখাচ্ছি আর যেভাবে শিখাচ্ছি সেগুলি কি ঠিক আছে? আমরা কি আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে ভাল মানুষ বানানোর চেষ্টা করছি? নাকি একেকটা লোভী স্বার্থপর তস্কর তৈরি করছি? আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার মধ্যেই সম্ভবত একটা বিরাট গলদ কোথাও রয়েছে। নাইলে এরকম হবে কেন? যেসব ছেলেমেয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হয়, ওরা ঘুষ খায়, চুরি করে- অথচ এইটা নিয়ে সামান্য একটু চক্ষু লজ্জাও ওদের নাই।
একেকজন কর্মকর্তাকে দেখি, দৃশ্যতই ওদের ওদের জীবনযাত্রার স্টাইল ও সম্পদের পরিমাণ ওদের আয়ের চেয়ে বেশী। অথচ এইটা নিয়ে ওরা একটু শরমও পায় না। আপনি একটু ভাবেন তো, একজন সরকারি কর্মকর্তা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এমন জীবনযাপন করছে যেটা ওর বেতন ইত্যাদির সাথে মেলে না। ছেলেমেয়েরা তো বোকা নয়। একজন কিশোর বা কিশোরী তো বুঝার কথা যে ওর পিতার বা মাতার আয় কত আর সেই আয়ে ওদের জীবনযাত্রার ব্যায় হওয়ার কথা না। তাইলে বাকি টাকা কোত্থেকে আসে। এ তো চুরির টাকা। আপনার ছেলেম্যেরা জানছে যে আপনি ওদেরকে চুরির টাকায় খাওয়াচ্ছেন পড়াচ্ছেন হলিডেতে নিয়ে যাচ্ছেন। লজ্জা লাগে না?
আমি তো এটাও দেখেছি যে ডাক্তারি পড়ে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কাস্টমসে চাকরী নিচ্ছে, পুলিশে চাকরীর চেষ্টা করছে। এইগুলি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? খুব জটিল কিছু কি? না, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সাংবাদিকতা করতে এসেছে বা লেখক হয়েছে বা সেরকম কিছ, সেইগুলি আমি বুঝতে পারি। কিন্তু কাস্টমস? পুলিশ?
ডাক্তারদের কথায় থাকি। আমরা তো জানিই যে আমাদের দেশের সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়তে যায় বা এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায়। সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করা ছেলেটা তো মানুষ হিসাবেও সবচেয়ে উত্তম হবার কথা। মানুষের প্রতি মমতাও তার সবচেয়ে বেশী হবার কথা, দায়িত্ববোধ বেশী হবার কথা। এইসব ছেলেমেয়েরাও তো এমনিই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা। আর কার্যত দেখা যাচ্ছে যে এরা দায়িত্বটুকুও পালন করতে চাচ্ছে না। যে জন্যে ওদেরকে বেতন দেওয়া হয়, যে জন্যে ওদেরকে সম্মান দেওয়া হয়- খোঁটাটা দিতে চাইনি, কিন্তু বলতেই হচ্ছে, যে জন্যে ওদেরকে এতো টাকা খরচ করে আমরা ডাক্তার বানিয়েছি, সেইটাই ওরা পালন করতে চায়না! আমাদের সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েগুলি এরকম মন্দ হল কি করে?
(৩)
মৃত্যু ঝুঁকির কথা বলছেন? পেশাগত ঝুঁকি তো থাকবেই। আর এই ঝুঁকি তো সকলেরই আছে। পুলিশের লোকজন প্রতিদিন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে না? মিলিটারির ছেলেমেয়েগুলি প্রতিদিন লেফট রাইট করে, আমরা হাসাহাসি করি বটে, কিন্তু এটাও তো জানি বটে যে দেশে প্রয়োজনে বুলেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে বলেই না ওরা এইরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই যে সাংবাদিকেরা দেখেন, কেবল এই করোনার সময় বলে কথা নয়, সবসময়ই নানাপ্রকার ঝুঁকির মধ্যে ওরা দায়িত্ব পালন করে না? করে তো। আপনি যখন ডাক্তারি পেশায় এসেছেন, ডাক্তারি বিদ্যা শিখেছেন, আপনি কি জানতেন না যে এইরকম ঝুঁকির মধ্যে আপনাকে পড়তে হতে পারে? পেন্ডেমিক বলেন আর এপিডেমিক বলেন, এ তো আজকেই যে প্রথম হয়েছে সে তো নয়।
আর এখন তো প্রটেকশন পোশাক ও গিয়ার এইসব নিয়েও কোন সমস্যা নাই। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে তো এইসব সমস্যা নাইই আরকি।
মানুষের যখন সবচেয়ে বিপদের সময়, সেই সময় যারা দায়িত্ব পালন থেক পালিয়ে আসে ওদেরকে কি বলবেন? নিন্দা করলেও ওরা বুঝবে বলে মনে হয় না। এ তো অনেকটা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সহযোদ্ধাদেরকে বিপদে ফেলে দেশকে বিপদে ফেলে পালিয়ে আসার মতো ব্যাপার আরকি। একটুও যদি আত্মসম্মান থাকে তাইলে এই ডাক্তার সাহেবরা সমাজে আর মুখ দেখাবেন না। ধিক। লেখক- ইমতিয়াজ মাহমুদ