হত্যার পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী। গ্রেফতার তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও পরিবারের অভিযোগ আড়ালেই থেকে যাচ্ছে বড় কোনো শক্তি। এদিকে, মাস্টারমাইন্ড গ্রেফতারে ব্যর্থতার কথা পুলিশ লিখিতভাবে আদালতে জানালেও, এখন বলছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলেই দেয়া হবে অভিযোগপত্র।
প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন স্ত্রী বলেন তিনি খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন সেই মানুষটিকে হারিয়ে পড়ুয়া তিন সন্তান নিয়ে খোদেজা বেগম আজ অথৈ সাগরে যেন।
গত ১১ মে। সর্বত্র যখন করোনার আতঙ্ক তখন অনেকটা সুকৌশলে কর্মস্থলের কথা বলে মিরপুরের বাসা থেকে বের করে আনা হয় দেলোয়ার হোসেনকে। ওইদিন বিকেলে উত্তরার একটি জঙ্গলে মেলে তার মরদেহ। পরে স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন, দেলোয়ারের সহকর্মী, সহকারী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান সেলিম, ভাড়াটে খুনি হেলাল হাওলাদার ওরফে শাহীন ও গাড়িচালক হাবিব। যাদের প্রত্যেকেই হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে। তবে সূত্র বলছে, হত্যার সুস্পষ্ট তথ্য উঠে আসেনি জবানবন্দিতে। এদিকে পরিবারের দাবি আনিসুর ছাড়াও হত্যার নেপথ্যে থাকতে পারে বড় কোনো শক্তি। কর্মস্থলে চলমান শতকোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ঠিকাদারদের সঙ্গে বিরূপ সম্পর্ক ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দিকে সন্দেহের তীর তাদের।
নিহত দেলোয়ারের স্ত্রী খোদেজা বেগম বলেন, ‘উনি বাসায় মনিরের নাম বলত। মেয়রের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অফিসে সে নাকি তদবিরের জন্য আসে।’ নিহত দেলোয়ারের বড় ভাই নূর নবী বলেন, ‘মনির তার কাজ কমপ্লিট হওয়ার আগে বিল সাবমিট করতেন। না দিলে গালাগালি করতেন।’
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। বন্ধুর জায়গায় বন্ধু কাজের জায়গা কাজ।’এদিকে গ্রেফতার আনিসুরের হোয়াটসঅ্যাপের তথ্য চেয়ে আদালতে পুলিশের আবেদনে স্পষ্ট, হত্যার মাস্টারমাইন্ড উদঘাটনে বাহিনীর ব্যর্থতা। তবে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস উপপুলিশ কমিশনার মো. ওয়ালিদ হোসেন বলছেন, এখন পর্যন্ত গ্রেফতার তিনজনের বাইরে পাওয়া যায়নি অন্যকারো সম্পৃক্ততা। নিহত দেলোয়ারকে ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কোনাবাড়ি থেকে প্রত্যাহার করে নগরভবনে সংযুক্ত করা হয়েছিল। এর পাঁচ মাস পর আবারও তাকে বদলি করা হয় কোনাবাড়ি। এর দুই মাস পরই খুন হন তিনি।
অনৈতিক সুবিধা না নেওয়ায় খুন হন প্রকৌশলী দেলোয়ার
ঠিকাদারদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা না নেয়া, মেয়রের সাথে মতের অমিল এবং পদ পদবী নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেনকে। দেলোয়ার হোসেনের সহকর্মী সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান সেলিম ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
এ ঘটনায় দেলোয়ার হোসেনের সহকর্মী সহকারী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান সেলিমকে আটক করলে পরিকল্পিতভাবেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেন। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে নিহতের স্ত্রী খাদিজা আক্তার অভিযোগ করেছেন, ঠিকাদারদের শতকোটি টাকার ফাইল আটকে রাখার কারণে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তার স্বামীকে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেলোয়ার ছিলেন একজন সৎ কর্মকর্তা। গাজীপুর সিটি করপোরেশন থেকে তাকে প্রায় ছয় মাস (সেপ্টেম্বর-জানুয়ারি) ওএসডি করে রাখা হয়। এরপর তাকে বদলি করা হয় কোনাবাড়ী অঞ্চলে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী অঞ্চল অফিস সূত্রে জানা যায়, এ অঞ্চলের ঠিকাদারদের কাজের পাওনা শতকোটি টাকার একাধিক ফাইল আটকা রয়েছে। এসব ফাইল তদন্ত করে ঠিকাদারি কাজে গাফিলতি পেয়েছে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা। ফাইলগুলো প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের টেবিলে আটকা পড়ে ছিল।
ঠিকাদারদের একটি চক্র ফাইলে ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য তার কাছে বেশ কয়েকবার তদবির করেন। ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাবও তাকে দেওয়া হয়। কিন্তু দেলোয়ার কোনো অবস্থাতেই ঘুষ নেবেন না বলে জানিয়ে দেন। এ নিয়ে প্রকৌশলী দেলোয়ারের সঙ্গে ঠিকাদারদের প্রকাশ্যে বিরোধ শুরু হয়।
স্থানীয় কাউন্সিলর মো. সেলিম রহমান বলেন, তিনি ভদ্রলোক ছিলেন। যতোটুকু জানা যায় ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোন সুবিধা বঞ্চিত হওয়া এবং পদপদবী নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে এ হত্যাকা- সংগঠিত করেছে আসামিরা।
গত ১১ মে সকালে মিরপুরের বাসা থেকে দেলোয়ারকে আনতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন অফিস থেকে নিয়মিত পাঠানো গাড়ি না গিয়ে অন্য একটি গাড়িটি যায়। ওই গাড়িতে করে দেলোয়ার গাজীপুরের কোনাবাড়ি অফিসের উদ্দেশে রওনা হলেও শেষ পযন্ত আর অফিসে পৌঁছতে পারেননি। ওই দিন দুপুরে রাজধানীর তুরাগ থানার দিয়াবাড়ীর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে ১২ মে ডিএমপি‘র তুরাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী সেলিম হোসেন, গাড়িচালক হাবিব ও ভাড়াটে খুনি শাহিন হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রকৌশলী হত্যাকারীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ১৯৮৬-৮৭ ব্যাচের এ্যালামনাই শিক্ষার্থীদের সংগঠন ফোরাম-৮৬।