নুসরাত রীপা
পর্ব-১৬
তুলির বিয়েতে মীরা আসবে না শুনে বিজুর খুব মন খারাপ । মীরাকে মায়ের কলিজা বলে মা কে ক্ষ্যাপালেও মীরাকে ও আপন বোনের মতোই ভালোবাসে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বিজু মায়ের ঘরে আসে। তুলির বিয়ে, বাড়িতে এই প্রথম নতুন প্রজন্মের বিয়ে আয়োজনও তাই ব্যাপক। মা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। বিজু মায়ের পাশে বসে বলল, মা একটা কথা বলি।
বল।
তুলির বিয়েতে আমি থাকছি না।
কেন রে?
মীরাকে বিয়ের কথা জানানো হয়নি। ও অনেক কষ্ট পাবে মা। আমি না থাকলে বলতে পারবো আমাকেও জানাও নি।
বোকা ছেলে। এটা কোন কথা! তুলি তোর ছোট বোন না? না থাকলে তুলি মনে কষ্ট পাবে না?
না, মা। তুলিও মীরাকে অনেক ভালোবাসে। মীরা তো আমাদের বোনই মা। ভার্সিটিতে ক্লাস বন্ধ, তাই এসেছিলাম। কাল আমি হলে ফিরে যাব।
তোর দাদীমনি রাগ করবেন।
আহা, শান্তা। বিজু এখন বড় হয়েছে। ও এখন ভোটার। মানে ও এখন নিজস্ব স্বাধীন চিন্তা ভাবনা আর মত প্রকাশের ক্ষমতাধারী। কাজেই ওকে ওর সিদ্ধান্ত নিতে দাও। আজমল সাহেব শোয়া থেকে উঠে বসলেন।
তুলির বিয়ের খবরটা মীরাকে না জানানো বিষয়টা বাড়ির কেউই মেনে নিতে পারছেনা। কিন্তু হুর ইজান্নাত কে কে বলবে!
বিজু মায়ের ঘর থেকে নিজের ঘরে চলে আসে। মীরার কথা মনে পড়ে। মীরা তো কখনো কারো সাথে রাগ করে কথা বলে না, ঝগড়া করে না। ছোটবেলা থেকে মেয়েটা জানেনা ওর বাবা মা কে। ওর কী ধর্ম। ওর জন্ম কোথায়। কেবল মিশনারী স্কুলের স্মৃতি নিয়ে ও বেড়ে উঠেছে অচেনা এক বাড়িতে। যদিও এ বাসায় সবাই ওকে স্নেহ আদর করে ঠিকই, কিন্তু সেটা তো বাসার মেয়ে হিসাবে নয়। এতিম অসহায়
মানুষ হিসাবে।
দাদীমনিতো কখনোই ভালোবাসেননি মীরাকে। বিজুরাও দাদীমনিকে মিছে কথা বলে মীরাকে বকা খাইয়েছে কত! মীরা এসব পরে আর মনে করেনি। ভুলে গেছে। কত কাজ আগ বাড়িয়ে করে দিয়েছে বিজু শাওন তুলিদের।
এতিম বলেই বোধহয় ও সব মেনে নিয়েছে সব সময়।
ঘুমোসনি?
দরজার বাইরে থেকে মাথা ঢুকিয়ে বলে শাওন। বিজুর ঘরে শব্দ শুনে এসেছে।
না। তুই?
গান বাছছিলাম। পরশু ডিজে আনছি–
ওয়াও।
আগামীকাল ফুপুরা চলে আসবে সব।
ছোট ফুপুও আসবে? বলে মুখটা একটু বাঁকা করে বিজু। শাওন বলে, হা। আসবে তো। কিন্তু তুই মুখ বাঁকাচ্ছিস কেন?
না, বলছিলাম তাহলে তো অরিত্রিও আসবে।
ছোট ফুপির ক্লাস নাইনে পড়া অপরূপা সুন্দরী কন্যা অরিত্রিকে শাওন মনে মনে পছন্দ করে। বিজু তাই এটা নিয়ে ওকে ক্ষ্যাপাতে ভালোবাসে।
বিজুর কথায় শাওন কণ্ঠে ঝাঁঝ ঢেলে বলে,আসলে আসবে। ঘুমাতে গেলাম।
বিজু দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে, যা। কাল তোর ফ্রেস থাকাটা জরুরী!!
শাওনের ঘরের দরজা লাগানোর শব্দ কানে আসে! বিজু বিড়বিড় করে, ভালোই হবে, এত মানুষ আসবে, মীরা না এলেই ভালো। কে কী বলে ফেলে কে জানে!! লোকজনের তো উল্টোপাল্টা কথা বলতে জিভ সুরসুর করে! হঠাৎ মীরার জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। মীরা যখন শুনবে তুলির বিয়ে হয়ে গেছে, ওকে জানানো হয়নি কত কষ্টই না পাবে।
বিজু ঠিক করে কাল সকালের ট্রেনেই ও ঢাকা যাবে। ঢাকায় নেমে মীরা কে ফোন দেবে। হোক না আপন নয়, তবু বোন তো!মা তো বিজু শাওন আর মীরাকে আলাদা ভাবেনি কখনো। তাহলে বিজু কেন ভাববে।
এই প্রথম বিজু মীরাকে চমকে দেওয়ার জন্য কী নেওয়া যায় ভাবতে থাকে।
বিজু ওর ছোট্ট ট্র্যাভেল ব্যাগটায় দুটো টিশার্ট ভরে। একটা জিন্স। দাঁড়ি রাখে তাই শেভিং কিটস নেওয়ার দরকার নাই। টুথপেস্ট, টাওয়েল— ভরতে ভরতে ভূপেন হাজারিকার আমি এক যাযাবর বইটা ব্যাগে ভরে নেয়। বইটা রবিনের কাছ থেকে পড়ার জন্য এনেছিল। কিন্তু সিএসইর ছাত্র হলেও বই পড়ায় ওর আগ্রহ নেই। বইটা মীরা পেলে খুশি হবে। রবিনকে পরে বোঝানো যাবে। আপাতত মীরাকে খুশি করার কথা ভাবে বিজু।
পর্ব-১৭
এরকমটা হবে অয়নের ধারণাতেও ছিল না। ও ভালো কাজ করে। কাজের প্রতি সিনসিয়ার। কোন এসাইনমেন্ট ধরলে দিন রাত এক করে সেটা কমপ্লিট করে। অথচ ওকে পানিশমেন্ট ট্রান্সফার দিয়ে হিলট্রাক এ পাঠিয়ে দিয়েছে।
স্থানীয় এক রাজনীতিবিদের মাদক চোরাচালানে অয়ন সমস্যা করছিল। পর পর দুটো চালান চোরাচালানীসহ ধরা পড়েছে। ট্রান্সফারটা সম্ভবত তিনিই করিয়েছেন।
তা যেই করাক এই মুহূর্তে বান্দরবন যাবার ইচ্ছে ছিল না অয়নের। সামনে বিয়ে। জেবা ঐ রকম বুনো পাহাড়ী এলাকায় থাকবে কীভাবে? বেড়ানোর জন্য পাহাড়-সাগর-জঙ্গল যতই আকর্ষক হোক না কেন বসবাসের জন্য মোটেও ভালো নয়। বিশেষ করে জেবার মতো আজন্ম শহরে লালিত মেয়েরা দুচারদিন গ্রাম- পাহাড়-জঙ্গলে বেড়াতে যেতে ভালোবাসলেও এসব পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে থাকার ক্ষমতা এদের নাই। অবশ্য জেবার সাথে বিয়েটা হবে কী না সেটাও এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অয়নের সাথে রাগ করে জেবা কথা বলা বন্ধ রেখেছে। একটা টেক্সট ও দিয়েছে, আপনি মীরা না খিরা কে ভালোবাসেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। আপনাকে আমি বিয়ে করবো কী না সেটা এখন আমার ভাবনা। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা তাই ভাবনাটা আপাতত তালাবদ্ধ করে রাখছি। পরীক্ষার পর চূড়ান্ত মতামত জানাব। আপনার ইচ্ছে হলে এখন গার্ডিয়ানদের জানিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিতে পারেন। সেটা আপনার ইচ্ছে।
আমি এখন আর এসব ভাববো না “।
এইরকম টেক্সট পড়ে অয়ন হতভম্ব। মীরার সাথে প্রেম কেন ভালো বন্ধুত্বটাই তো হয় নি। মেয়েটা কেমন শিউলি ফুলের মতো। সেজন্যেই না অয়ন বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে। শিউলি ফুল ঝরে গেলেও দীর্ঘ সময় থাকে কিন্তু মালা গাঁথলেই খানিক বাদে নষ্ট হয়ে যায়! আর মীরার সাথে প্রেম বিয়ের কথা ভাবেও নি অয়ন। একজন মানুষকে আরেকজন মানুষের ভালো লাগতেই পারে। সব ভালো লাগাই তো বিয়ের জন্য নয়।
জেবা মেয়েটা সুন্দরী। কিন্তু প্রায় দশ বছরের ছোট বলে অয়ন শুরুতে সম্পর্কটা করতেই চায়নি। কিন্তু অভিভাবকদের নানা মোটিভেশনাল কথা বার্তা আর রূপের মোহে টুপ করে রাজি হয়ে গিয়েছিল। জেবার টেক্সট আর ট্রান্সফার দুইয়ে মিলে একটা বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে নতুন কর্মস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করেছে অয়ন।
বাসে,জার্নিতে সব সময়ই ভীষণ ঘুম পায় অয়নের। চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু মনের মধ্যে নানা রকম চিন্তা ঘুরপাক খায়। আগামী বছর প্রমোশন। এই পানিশমেন্ট ট্রান্সফার ওর চাকরীর ওপর কতখানি প্রভাব ফেলবে কে জানে। আবার ছোটবেলা থেকেই অয়নকে সবাই ভালো ছেলে বলে জানে। জেবা যদি বিয়ে ভাঙার কারণ হিসাবে অয়নের অন্য নারীর সাথে প্রেম আছে বলে কমপ্লেন করে সেটা অয়নের জন্য অবশ্যই মঙ্গলজনক হবে না। প্রেম থাকলে তো অয়ন নিজের প্রেমিকাকেই বিয়ে করতো। বাড়িতে বাবা মা কোন বাধাই দিতো না। অয়ন এসব প্রেম ট্রেমে জড়াতে চায়নি। অথচ জেবা সেটা নিয়েই কথা বলছে।
মীরার কথা মনে পড়ে অয়নের। নিতান্তই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে পরস্পরের পরিচয়। একই এলাকার হিসেবে অয়ন যোগাযোগ টা রাখতে চেয়েছিল। মীরার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাওয়া বা ওকে ফোন করাটা কি আসলেই অন্যায় হয়েছে? নিজের কাছেই উত্তর খোঁজে অয়ন।