ধর্ষণ বন্ধের জন্য ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের আইন করেছে সরকার। ইতিমধ্যেই ধর্ষণ মামলার একটি রায়-এ আসামীদের মৃত্যুদ- দিয়েছে আদালত। কিন্তু তারপরেও থামছেনা ধর্ষণ। কিন্তু কেন? সামান্য কয়েক মিনিটের শারিরীক সুখানুভূতির জন্য মানুষ কেন তার জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে ? এটা কি কোন মানসিক রোগ নাকি বিকৃত কামলালসা? কেন এই মনোদৈহিক পাশবিকতা ? এসব একাধিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তৈরি হয়েছে এ প্রতিবেদন।
নিজস্ব প্রতিবেদক : ধর্ষণ কী? ধর্ষণ এক রকম যৌন অত্যাচার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচার পরিসংখ্যান ব্যুরোর (১৯৯৯) হিসাব অনুসারে সেদেশের ধর্ষিতদের মধ্যে ৯১ শতাংশ মহিলা ও ৯ শতাংশ পুরুষ। আর ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধী পুরুষ।
পুরুষ নিজেও নারী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হতে পারে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের আইনে একে ধর্ষণ বলা হয় না। কিন্তু এ নিয়ে এক নতুন সমীক্ষা চালানোর পর একজন গবেষক বলছেন, হয়তো এখানে পরিবর্তন আনার সময় হয়েছে। ব্রিটেনের ল্যাংকাস্টার ইউনিভার্সিটি লস্কুলের ড. সিওভান উইয়ার ২০১৬-১৭ সালে যুক্তরাজ্যে ‘একজন পুরুষকে জোরপূর্বক যৌনমিলনে বাধ্য করার’ ওপর প্রথম গবেষণা পরিচালনা করেন। (বিবিসি, ২০১৯)
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ দায়ী বিধায় একজন ‘পুরুষ’ হিসেবে ধর্ষণ নিয়ে লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। শুধু মেয়েশিশু নয়, ছেলেশিশুও ‘ধর্ষিত’ হয়। ছেলেদের বেলায় আমরা বলি ‘বলাৎকার’। ধর্ষণ ও বলাৎকার একই রকম অর্থ বহন কওে, একই রকম ঘৃণ্য অপকর্ম। শুধু শিশু নয়, বড় ছেলেরাও অন্য কোনো ‘পুরুষ’ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে পারে। আর নারীর ওপর নির্যাতন তো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
পুরুষই সিংহভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত বা অপরাধী। একটি ছেলেশিশু তার শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে একদিন ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠে। অনেক ছেলেশিশু আবার কৈশোরেই ‘পুরুষ’ হয়ে যায়।সব ছেলেশিশুই একদিন ‘পুরুষ’ হবে, এটাই স্বাভাবিক। অনেকে দেখতে-শুনতে ‘পুরুষ’, কিন্তু প্রকৃত অর্থে ‘পুরুষ’ না। প্রকৃতপক্ষে তাহলে ‘পুরুষ’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? কী তার বৈশিষ্ট্য? কী কী সামর্থ্য থাকলে একজনকে ‘পুরুষ’ বলা যায়? পাশাপাশি শিশুর সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণের সময় এসেছে বলে মনে করছি।
‘পুরুষ’-এর নানা বৈশিষ্ট্য বা সামর্থ্যকে বলা হয়ে থাকে পৌরুষ বা পুরুষত্ব। একজন আদর্শ পুরুষের ‘পৌরুষ’ কেমন হতে পারে। ‘পৌরুষ’ কি শুধু যৌনতা-ভিত্তিক বৈশিষ্ট? নাকি মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, নীতি-নৈতিকতা, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সুস্থ এবং সুষ্ঠু ধারণাও ‘পৌরুষ’-এর অনিবার্য বৈশিষ্ট্য? ঠিক কোন পর্যায়ে বা কী কারণে একটি ছেলেশিশু ধর্ষক হয়ে ওঠে? আমাদের সমাজে, পরিবারে, টেলিভিশনে বা সিনেমার পর্দায় কি এমন কিছু আছে যা সেদিনের ছেলেশিশুকে আজ ধর্ষকে রূপান্তর করছে? জীবনের সবকিছু ছাপিয়ে কারও কারও কাছে কি তবে যৌনতাই প্রধান বিষয় বা চাহিদা হয়ে উঠছে।
ড. খুরশিদ আলমের লেখা ‘সমাজবিজ্ঞানের ধ্রুপদী ও আধুনিক তত্ত্ব’ শীর্ষক গ্রন্থের ১১৬ নম্বর পৃষ্ঠার শুরুতে বিধৃত আছে, বহুল আলোচিত শরীরতত্ত্ববিদ এবং মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড দাবি করেছিলেন যে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তিন বছর বয়স থেকে গড়ে ওঠে। মজার বিষয় হলো, ফ্রয়েড নিজে তার তিনবছর বয়সের জীবন সম্পর্কে কোনো কথাই মনে করতে পারেননি। ফ্রয়েড-বর্ণিত ‘লিবিডো’ ধারণা দিয়ে আমরা মানুষের ‘যৌনবোধ ও কাম’-এর সূচনাকাল সম্পর্কে জানতে পারি। খুরশিদ আলমের বই থেকে জানা যায়, ‘শিশুকাল থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত মানবদেহে যে কামপ্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকে, ফ্রয়েড তাকেই লিবিডো বলছেন। ‘লিবিডো হলো কামজ সহজাত প্রবৃত্তি। কাম বলতে শুধু বয়সের লৈঙ্গিক স্তরকে বোঝায় না। জীবনের সবকিছুর মূলে একমাত্র যৌনপ্রেরণাকেই ফ্রয়েড স্বীকার করেছেন। লিবিডোর দুটি বিশেষ ধরনের উল্লেখ করেছেন ফ্রয়েড, যার সাথে ‘নিপীড়নের মাধ্যমে’ ‘যৌনসুখ’ লাভ করার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। একটি হলো গধংড়পযরংস বা মর্ষকাম, আরেকটি হল ঝধফরংস বা ধর্ষকাম। মর্ষকাম হলো ব্যক্তির আত্মপীড়নের মাধ্যমে যৌনসুখ লাভ করা এবং ধর্ষকাম হলো নিপীড়ন করে যৌনসুখ লাভ করা। একটি ছেলে বড় হয়ে কোন পর্যায়ে বা কী পরিস্থিতিতে ধর্ষক হয়ে ওঠে? পরিস্থিতি বিশ্লেষণে আমরা দুই রকমের ধর্ষণের ঘটনা দেখতে পাই। সাময়িক উত্তেজনায় একজন পুরুষ ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। আবার পরিকল্পনা করে, টার্গেট নারীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলনকেই ধর্ষণ বলা যায়। এডাল্ট নয় শুধু, চার-পাঁচ বছরের মেয়েশিশুও ধর্ষিত হয় বলে সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যে খবর দেখা যায়। একজন পুরুষ এই আগ্রাসন কেন চালায়? শুধুই কি যৌনকামনা চরিতার্থ করার জন্য ধর্ষণ করা হয়? নাকি পুরুষের ‘শক্তি’ বোঝানোর জন্য ধর্ষণ করা হয়? কিংবা ধর্ষণ কি কারও কাছে প্রতিশোধের উপায়?
একটি ছেলেশিশু কীভাবে বড় হচ্ছে, পরিবারে, সমাজে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শরীর, মন, মেয়ে, নারী ইত্যাদি শব্দ বা সত্তার সঙ্গে কীভাবে পরিচিত হচ্ছে, সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টেলিভিশনে বা সিনেমার পর্দায় সে নারীকে কীভাবে উপস্থাপিত হতে দেখছে? পপুলার কমার্শিয়াল ফিল্মে ভারতীয়রা আইটেম গার্ল নামে একটি বিষয় সফলভাবে যুক্ত করতে পেরেছে। আমাদের দেশের অসৃজনশীল নকলপ্রিয় নির্মাতারাও আইটেম গার্ল কনসেপ্ট চর্চা করছেন। একজন ভিলেন আইটেম গার্ল নিয়ে ‘মাস্তি’ করবেন না, সেটা যেন হতেই পারেনা। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমায় তো রাস্তায় মেয়ে দেখলেই ভিলেন ও তার দল ‘ধর্ষণ’ করার জন্য ধাওয়া করে। ধাওয়া খাওয়া মেয়েটি নায়িকা হলে নায়কের আকস্মিক হস্তক্ষেপে বেঁচে যায়। যদি সে হয় নায়কের বোন, কিংবা অন্য কোনো পক্ষ, তাহলে নির্দেশকরা মেয়েটির ধর্ষণের ব্যবস্থা করেন। খুবই রগরগে সে দৃশ্য। এমন চলচ্চিত্র বা আইটেম সং বা আইটেম গার্লের ব্যবহার সমাজে ছেলেদেও ধর্ষণের মতো অনাকাঙ্খিত ক্রিয়ায় অংশ নিয়ে উস্কানি দিচ্ছে কি না সেটা সরকার, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের ভাবতে হবে।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে একটি গ্রামে। অন্যদিকে বনানীর সে ঘটনা ঘটেছিল একটি এক্সপেন্সিভ হোটেলে। বনানীতে ধর্ষক ও ভিকটিম উভয়পক্ষই ‘শিক্ষিত ও অবস্থাসম্পন্ন’। ফলে এখানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আসবেনা। কেউ কেউ বলছেন, মেয়েরা ওখানে গেল কেন? ধর্ষণের ক্ষেত্রে অনেকে মেয়েদের পোশাক নিয়েও কথা বলে। বোরখা পরেও যে অনেকে ধর্ষণ থেকে বাঁচতে পারেনা, তার উদাহরণ কুমিল্লার তনু ধর্ষণ ও হত্যাকা-। এখানেই একজন পুরুষের ‘পৌরুষ’কে বোঝার সুযোগ আছে। কাপড় ছাড়া, কিংবা কাপড় কম থাকলেই কি মেয়েদের ধর্ষণ করতে হবে? পুরুষ কর্তৃক নারী ধর্ষণের ঘটনায় যারা নারীর দোষ খুঁজে বেড়ান, আমার মতে, তারাও কোনো না কোনো সময় ধর্ষক হয়ে উঠতে পারেন। যৌনতা দেহ ও মনের একমাত্র উপাদান নয়, অনেকগুলো উপাদানের একটা মাত্র। অন্যান্য উপাদানগুলো ছাপিয়ে যখন যৌনতা প্রধান হয়ে ওঠে, তখনই বিপত্তি বাধে। আপনার ছেলেসন্তান কী শিখে বড় হচ্ছে, সেটা এক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গবেষণা করে বলতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, পড়ালেখার পাশাপাশি একটি শিশুকে যদি খেলাধুলা, ব্যায়াম, সুস্থ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত রাখা যায়, তাহলে যৌনতাকেই জীবনের প্রধানতম বিষয় হিসেবে শিখবেনা আমাদের সন্তানরা।
পুরুষকে অনুধাবন করতে হবে যে নারী ভোগ করার কোনো পণ্য বা দ্রব্য নয়। নারী একটি ভিন্ন সত্তা হলেও পুরুষের তথা সভ্যতার অস্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভর করে নারীর ওপর। নারীকে ধর্ষণ করা বা নির্যাতন করা প্রকৃত পুরুষের জন্যও লজ্জাজনক। ধর্ষণ কোনোভাবেই পৌরুষের বৈশিষ্ট হতে পারেনা। ধর্ষণ দুর্বল পুরুষের অমার্জনীয় অপরাধ। সিনেমায়, নাটকে দেখালেও নারী আসলে ভোগ করার বিষয় নয়। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রদর্শন করেই কেবল একজন পুরুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারেন। এত কিছু বলার পরেও যে পুরুষ শোধরাবেনা, তার জন্য আছে পুলিশ, আইন, আদালত।
বনানীর ঘটনায় আমরা দেখেছিলাম, পুলিশ কর্মকর্তা মামলা না দিয়ে দুই-তিন দিন ভিকটিমদের ঘুরিয়েছেন। পুলিশ যদি মামলা না নেয়, আসামিদের গ্রেপ্তার না করে, তাহলে দুটো রাস্তা খোলা থাকে। আদালত ব্যবস্থা নিতে পারে অথবা জনসাধারণ যদি হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে আসে তাহলেও পুলিশ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। নোয়াখালীর নারীর ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনায় আমরা দেখলাম, এক মাস আগের ঘটনা। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়াতে সবার টনক নড়েছে। গ্রাম্য রাজনীতি, বিশেষ করে গ্রাম্য মাতব্বরদের জন্য অনেক তথ্য প্রশাসনের কাছে পৌঁছায় না। আর প্রশাসন সদরে বসে মনে করে সবকিছু ঠিক আছে। এক মাস আগে একজন নারী এভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। আর এতদিন ধরে প্রশাসন জানতে পারেনা!! এই ব্যর্থতা কার?
আমি আপনি চাইলেই সমাজ বদলে যাবে না। মানুষ হয়ে জন্মালেও কেউমানুষ হয় না, তাকে নির্মাণ করতে হয়। একজন মানুষ বড় হয়ে কি ধর্ষক হবে নাকি সুস্থ মানুষ হবে, এটা নির্ভর করে তার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ওপর। শিক্ষাব্যবস্থায় এত গলদ রেখে ধর্ষণমুক্ত সমাজ নির্মাণ সম্ভব নয়। শিক্ষা মানে এ বি সি ডি; অ আ ক খ কিংবা আলিব বা তা সা নয়। শিক্ষা মানে ‘মানুষ’ কী তার এহসাস, শিক্ষা মানে চরিত্র, শিক্ষা মানে সমাজে বদনাম হয়ে সম্মান হারানোর ভয়, শিক্ষা মানে শক্ত মানসিকতা, শিক্ষা মানে নর হয়ে নারীকে সম্মান করা, নারী হয়ে নরকে সম্মান করা। শিক্ষা মানে মন ও শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ। এখন বলুন, আমাদের সমাজ কি এমন? একজন সুস্থ পুরুষ নির্মাণ কী বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভব? ওই যে বললাম, পরিবার। পরিবার ও সমাজ মিলে ব্যক্তিকে তৈরি করে। সেখানে স্কুল, শিক্ষক, মাঠ, সংগীত, সিনেমা, ধর্ম- সব মিলেই মানুষ তৈরি হয়। সমাজ ঠিক না থাকলে পরিবারও দূষিত হবে।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের নানা রূপ, প্রকৃতি আমরা দেখতে পাই। কিছু সন্ত্রাসী কর্মকা- আছে যেগুলোর বিস্তার লিঙ্গ, বয়স বা অন্য কোন গ-ির ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে না। আবার কিছু কর্মকা- নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী, লিঙ্গ বা বয়সের মানুষকে লক্ষ্য করেই ঘটে থাকে। যেমন ধর্ষণ নামক ঘৃণিত কাজটি শুধু নারীকে টার্গেট করে ঘটে থাকে। নারীকে হেনস্থা করার এ এক চিরায়ত নিন্দিত, ধিকৃত এবং ন্যক্কারজনক পদ্ধতি যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। শুধু পরিবেশ বা পরিস্থিতিভেদে তার স্বরূপ বা মাত্রা ভিন্ন। পারিবারিক ও সামাজিক সুস্থির পরিম-লে যেমন এটা ঘটে থাকে তেমনিভাবে যুদ্ধক্ষেত্রেও নারীকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করে তাদেরকে অপহরণ, আটক এবং ধর্ষণ করা হয়ে থাকে। ভাবখানা এমন নারী যেন চিরায়ত এক ভোগ্যপণ্য!
আমরা এখন নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবি করি ঠিকই কিন্তু বিশ্বব্যাপী ধর্ষণ নামক নারীত্বের অবমাননা চলছেই। মনে হচ্ছে দিনে দিনে এর মাত্রাবৃদ্ধি হচ্ছে। অবশ্য অনেকে বলে থাকেন আগে এটা যেভাবে, যে মাত্রায় ঘটত সেটার প্রচার এখনকার মতো এত বেশি না থাকার কারণে মনে হতে পারে এখন নারীরা বেশি ধর্ষিত হচ্ছেন। আমি এ বক্তব্য ঠিক না বেঠিক অহেতুক সে বিতর্কে যেতে চাচ্ছি না। শুধু বলতে চাই, পরিসংখ্যানের যে তথ্য আমরা বর্তমানে দেখছি বস্তুত সেটাও ধর্ষণ নামক হিংগ্রতার অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্রই এবং নিঃসন্দেহে তা ভয়াবহও বটে। আমি শুধু বলতে চাই, ধর্ষিতার কাতর চিৎকার আমাদের এমন সভ্য সমাজের ( আমরা নিজেদেরকে যেহেতু সভ্য বলছি!) সাথে একদমই যায় না। বিশ্বব্যাপী এ ঘৃণ্য ঘটনা ভয়াবহভাবে ঘটে চলেছে। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলছে। আগেই বলেছি যতটুকু ধর্ষণের প্রকাশিত হচ্ছে সেটাও ঘটে চলা নৃশংসতার এক অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনিকোলজি এন্ড অবসটেট্রিক্স, ২০০২ এ প্রকাশিত নিবন্ধ বলছে যে, উন্নয়নশীল দেশে ধর্ষণের ঘটনা যতটা ঘটে তার মাত্র ১০-১৫% ঘটনা জনসমক্ষে আসে। তাহলে বুঝুন এটা কি মাত্রায় ভয়াবহ! মনে হয়, যে কোন ফৌজদারী অপরাধের চেয়ে এটা বেশি ঘটছে।
এখন আসুন সংক্ষেপে এটার আর্থ-সামাজিক এবং মনস্তাত্বিক দিক একটু বিশ্লেষণ করি। সাধারণত দেখা যায়, আর্থ-সামাজিক দিক থেকে যে সমস্ত নারীরা পিছিয়ে আছে এবং যাদের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে তাদের উপরেই ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। আবার এ সকল নারীরা শিক্ষায়ও পিছিয়ে পড়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ৭৫-৮০% নারীরা তাদের পূর্ব পরিচিত লোকদের দ্বারাই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।
আমাদের দেশে ২০১১ এবং ২০১৫ সালে প্রকাশিত দুটো গবেষণা নিবন্ধে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। নিবন্ধ দুটো ২০১১ এবং ২০১৫ সালে আর্মড ফোর্সেস এবং ডেল্টা মেডিকেল কলেজের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এ নিবন্ধ দুটোতে ২০০৬ এবং ২০০৭-২০১১ মেয়াদে যে সমস্ত ধর্ষিতা নারীরা ঢাকা এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ধর্ষণ পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এসেছিলেন তাদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। (সূত্রঃ অষ-অুধফ বঃ ধষ, ২০১১; ঘড়ংিযবৎ ধষর বঃ ধষ, ২০১৫) তাহলে, দেখা যাচ্ছে, নারীরা কিন্তু তার পরিচিত মানুষের দ্বারাই বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। কি নিদারুণ কষ্টের ব্যাপার একটু ভাবুন তো!
যে বয়সে একটি মেয়ে শিক্ষা-দীক্ষা এবং হাসি-উচ্ছ্বলতায় চেনাজানা মানুষদের সাথে সময় পার করার কথা, জীবন সম্পর্কে মাত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে নিজেকে উপযুক্ত করে তোলার প্রচেষ্টায় সময় অতিবাহিত করার কথা সে বয়সেই তারা এমন একটি মনোদৈহিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে (তাও পরিচিত মানুষের দ্বারা)! তাহলে পরবর্তী সময়ে সে কাকে বিশ্বাস করবে? আবার এমন পরিচিত হওয়াতে সে না পারে কাউকে কিছু বলতে; না পারে মুখ বুজে তা সহ্য করতে। ফলে দেখা যায় ধর্ষক কর্তৃক সে পুনঃ পুনঃ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে (এখনতো ভিডিও করে রেখে সেটা দিয়ে ব্লাকমেইল করা হয়) । এভাবে চলতে থাকলে এক সময় তার নিজের জীবনের উপরই বিরক্তি এসে যায় এবং একটা সময় যে কোনো পুরুষকে দেখলেই তার ভেতরে স্বাভাবিকভাবেই ঘৃণাবোধ তৈরি হয়।
যেখানে একবার ধর্ষিতা হওয়ার জন্যই পরিবার এবং সমাজে নারীকে অসতীর তকমা লাগিয়ে দেয় এবং সে গদ্বানি তাকে সারা জনম ধরেই বয়ে বেড়াতে হয়; সেখানে পরিচিত মানুষ দ্বারা পুনঃ পুনঃ ধর্ষণের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে ধর্ষিতার মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছে একবার ভাবুন তো! এ কারণে দেখা যায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়া এমন ধর্ষিতরা অনেক সময় আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। নারীত্বের অবমাননার এমন এক আদিমযুগীয় পন্থাকে তাই প্রতিরোধকল্পে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। তবে তরুণদের এখানে দায় ও দায়িত্ব দুটোই বেশি।
ধর্ষিতার কাছের মানুষদের উচিত এমন এক মানসিক অস্থিরতা এবং ভেঙে পড়ার সময়ে তাকে সর্বোতভাবে সহায়তা করা, তার মনোবল ধরে রাখতে সহযোগিতা করা এবং প্রয়োজন হলে মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। কোন অবস্থাতেই তাকে দায়ী করা বা কটূক্তি করে তার মনোযাতনা বাড়ানো এবং তাকে একাকী করে দিয়ে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিতে উৎসাহিত করা উচিত নয়।
যদিও বলা হয়ে থাকে, ধর্ষিত হওয়ার জন্য নারীর বয়স কোন ফ্যাক্টর নয়। ফলে একবারে শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কোন বয়সের নারীরাই ধর্ষণের শিকার হতে পারেন। বিভিন্ন সময়ে আমাদের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনও এমন তথ্যকেই স্বীকার করছে। কিছু বর্বর আছে যাদের টার্গেটই থাকে অল্প বয়সী, নাবালিকা মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা। বিকৃত মানসিকতার এমন লোক কিন্তু সংখ্যায় নেহাত কম নয়!
এ কারণে আমাদের উচিত অল্পবয়সী মেয়ে শিশুদেরকে অত্যন্ত আস্থাভাজন কেউ না হলে তার সাথে একাকী সময় কাটাতে না দেয়া। আবার তারা যখন মোটামুটিভাবে বুঝতে শিখে তখন বাবা-মা এবং পরিবার পরিজনের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে সার্বিক বিষয় বুঝিয়ে বলা। তার পরিচিত কেউ সে যেই হোক না কেন যদি তার সাথে ন্যূনতম অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে তাহলে আগে থেকেই পরিবারকে তার সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া। সেক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিকে পরিবারে আর ঢুকতে না দেয়া এবং তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে কালবিলম্ব না করা ; তা ঐ ব্যক্তি পরিবারের কাছে আগে যতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে থাকুন না কেন। কঠোর হওয়ার কিন্তু এখানে বিকল্প নেই।
আর যদি মেয়েটির বক্তব্যকে হেলা করেন এবং উক্ত ব্যক্তির আপনার বাড়িতে যাতাযাত আগের মতো চলতে থাকে তাহলে সে যেমন আস্কারা পাবে; আপনার মেয়েটিও কিন্তু তখন নিজেকে অসহায় মনে করবে। ফলে হয়ত এমন এক সময় আসবে যখন সে ব্যক্তি সুযোগ ও সময়মতো মেয়েটির সর্বনাশ করতে একদমই পিছপা হবে না। আপনার এতদিনের দেয়া অযাচিত গুরুত্ব তার কাছে শুধুই একটা সুযোগের হাতিয়ার বলে গণ্য হবে। সুতরাং দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষে কাজ কি বলুন?
নারীর জীবনে ধর্ষণ শুধুই একটা শারীরিক আঘাত নয়। এটা তার মনে চরম হতাশা এবং বিভীষিকার জন্ম দেয়। ফলে শারীরিক এ সন্ত্রাসের পরে স্বল্পমেয়াদে বা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। মেডিকেল পরিভাষায় একে বলে “রেপ ট্রমা সিনড্রোম।” এ রোগের লক্ষণ হলো শুরুতে মানসিক অস্থিরতা, ঘুমের ব্যাঘাত , আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়া, অহেতুক ভীতি ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। ট্রিটমেন্ট করলে ধীরে ধীরে লক্ষণগুলো কমে আসতে থাকে এবং ধর্ষিতা আবার মোটামুটিভাবে তার স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে পারে। আর ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট না করলে তা স্থায়ী মানসিক বিকৃতির কারণ হতে পারে। আগেই বলেছি, এ ঘৃণ্য সন্ত্রাস ধর্ষিতাকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতেও প্ররোচিত করতে পারে। তাই বলেছি, ধর্ষণ এক মনোদৈহিক সন্ত্রাস।
ধর্ষক নামের এমন সন্ত্রাসী যেন কোন পরিবারে বেড়ে না উঠতে পারে সে ব্যাপারে পরিবারের সবাইকে সবসময় সজাগ থাকতে হবে। ছেলে শিশুদেরকে পরিবার থেকেই উন্নত মূল্যবোধে গড়ে তুলতে হবে। যথাযথ নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। তাহলে নারীত্বের চরম অবমাননা করার আগে সে একটু হলেও ভাববে। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, ধর্ষিতার বাবা-মা হওয়ার চেয়ে সমাজে ধর্ষকের বাবা-মায়ের পরিচয়ে পরিচিতি পাওয়াটা হাজার গুণ অপমানজনক। এ কারণে ধর্ষকের কলংক যেন সন্তানের বদৌলতে পরিবারের গায়ে না লাগে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন সবসময়। আর আসুন, সকলে মিলে এমন একটা মানবিক সমাজ গড়ে তুলি যেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকলে তার যোগ্য সম্মান নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।