পিপিআরসি ও বিআইজিডির গবেষণা

মহামারি করোনাভাইরাসে অর্থনীতি ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়ায় দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত অন্তত ১৬ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়ে রাজধানী ছেড়ে চলে গেছে। সেই সঙ্গে নতুন করে দেশের আরো ১৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। আর ৭ শতাংশ মানুষ পেশা পরিবর্তন করেছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি ও বিআইজিডি’র এক যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার এক ভার্চ্যুয়াল সভায় ‘লাইভলিহুড, কোপিং অ্যান্ড রিকভারি ডিউরিং কোভিড-১৯’ শীর্ষক জরিপভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়।
পিপিআরসি ও বিআইজিডি বলছে, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যোগাযোগের ব্যয় এবং অন্যান্য ব্যয় মেটাতে না পেরেই এসব মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে এপ্রিল মাসে ৬ শতাংশ শহুরে দরিদ্র মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে যায়। জুনে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
জুন মাস শেষে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এছাড়া লকডাউন তুলে নেয়ার ফলে অনেকে কাজে ফিরলেও ১৭ শতাংশ পরিবারের এখন পর্যন্ত কোনো আয়মূলক কাজ নেই।
পিপিআরসি ও বিআইজিডি জানায়, গত ২০শে জুন থেকে ২রা জুলাই পর্যন্ত চালানো ওই জরিপে অংশ নেয় ৭ হাজার ৬৩৮ পরিবার। এরমধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি শহরের পরিবার, ৪৩ শতাংশের বেশি গ্রামের পরিবার এবং ১ দশমিক ২২ শতাংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবার। এবারের জরিপে গ্রাম এবং শহরের দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষও যুক্ত ছিল।
জরিপে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসে শহুরে দরিদ্র মানুষের আয় কমে গেছে ৪৩ শতাংশ, গ্রামের মানুষের আয় ৪১ শতাংশ আর পার্বত্য চট্টগ্রামের দরিদ্র মানুষের আয় কমেছে ২৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ১৭ শতাংশ জুনে এসে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বাসাবাড়িতে কাজ করত যেসব মানুষ, যাদের মধ্যে প্রায় বেশিরভাগই নারী, তাদের কাজ হারানোর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের সংখ্যা ৫৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। এরপর আছে অদক্ষ শ্রমিক, দক্ষ শ্রমিক। দেখা গেছে, কারখানার শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ হারানোর হার অপেক্ষাকৃত কম। দুই পেশাতেই ১০ শতাংশের কিছু বেশি।
লকডাউনের সময় এবং লকডাউন তুলে নেয়ার পর দরিদ্র পরিস্থিতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয় গবেষণায়। এতে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে যেখানে শহরে খাবারে ব্যয় ছিল ৬০ টাকা, এপ্রিলে তা কমে হয় ৪৪ টাকা। জুনে এসে এটি সামান্য বেড়ে হয় ৪৫ টাকা। শহরাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের খাবারের ব্যয়ে কিছু উন্নতি হলেও গ্রামে পরিস্থিতি লকডাউনের পরেও ভালো হয়নি। গ্রামে ফেব্রুয়ারিতে খাবার ব্যয় ছিল ৫২ টাকা। এপ্রিলে তা কমে হয় ৪১ টাকা, জুনে ৩৭ টাকা। আয়ের নিরিখে দেখা যায়, শহরাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের আয় ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১০৮ টাকার বেশি। এপ্রিল তা অনেকটা কমে হয়ে যায় ২৬ টাকা, জুনে দাঁড়ায় প্রায় ৬৭ টাকায়। গ্রামাঞ্চলে আয় ফেব্রুয়ারিতে ছিল প্রায় ৯৬ টাকা। এপ্রিল ও জুনে হয় যথাক্রমে ৩৭ ও ৫৩ টাকার কিছু বেশি।
জরিপে আরো বলা হয়, লকডাউনে সব শ্রেণির মানুষের আয় কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে রিকশাচালকদের আয়। তাদের প্রায় ৫৪ শতাংশ আয় কমেছে। এরপর আছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও অদক্ষ শ্রমিক। এই করোনাকালে এক নতুন দরিদ্র শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এপ্রিল মাসে তাদের সংখ্যা ছিল ২২ দশমিক ৮ শতাংশ। জুনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন চালু হয়ে গেছে, তখন এ সংখ্যা সামান্য কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ। চরম দরিদ্র, মাঝারি দরিদ্র, ঝুঁকিতে থাকা নতুন দরিদ্র এবং নতুন দরিদ্র সুনির্দিষ্টভাবে এই চার শ্রেণির মতামত উঠে আসে জরিপে।
সমীক্ষা প্রতিবেদনের একটি অংশ তুলে ধরে বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, সব শ্রেণির মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মনে করে লকডাউন প্রত্যাহার না করার কোনো বিকল্প ছিল না। প্রায় ৩০ শতাংশ একে ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে করে। ১০ শতাংশের মতো মনে করে, এটি কিছুদিন পর করা যেত, বাকিরা কোনো মন্তব্য করেনি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। এপ্রিল মাসের জরিপে আমরা দেখেছিলাম, ভালনারেবল নন-পুওর বা প্রায় দরিদ্র, যাদের মাথাপিছু আয় প্রাক-করোনাকালীন সময়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে কিন্তু মিডিয়াম আয়ের নিচে ছিল। তাদের মধ্যে ৭৩ শতাংশের আয় দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে চলে এসেছিল। আমরা তাদের বলছিলাম বাংলাদেশের ‘নব্য-দরিদ্র’। জুন মাসেও এই ‘নব্য-দরিদ্রদের’ প্রায় সবার আয় ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। এই নব্য-দরিদ্রদের হিসাবে ধরলে, বর্তমানে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার হয় ৪২ শতাংশ। শহরের বস্তি এলাকায় করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব হয়েছে আরো মারাত্মক।
ড. ইমরান মতিন আরো বলেন, আমরা আমাদের গবেষণা থেকে কর্মহীনতার অন্যতম যে ফলাফল পেয়েছি, তাহলো ফেমিনাইজেশন। নারীপ্রধান কর্মক্ষেত্র যেমন- গৃহকর্মী খাত, সেখানে নারীরা কর্মহীনতার শিকার হয়েছেন ব্যাপকভাবে। শুধু তাই নয়- আমরা দেখেছি, যেখানে নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন, সেখানেও এই সময়ে নারীদের অবস্থা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় বেশি খারাপ।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হলেও একে এক ধরনের ‘ভঙ্গুর পুনরুদ্ধার’ তৎপরতা বলা যায়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে দরিদ্র মানুষকে যে সহায়তা দেয়া হয়েছে, তা এক ধরনের ‘টোকেন সহায়তা’। এপ্রিলে আমরা যে নতুন দরিদ্র শ্রেণি সৃষ্টির কথা বলেছিলাম, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালুর পর তাদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রণোদনা কিছু কাজ করেছে। কিন্তু দেশের কর্মশক্তির ৮০ শতাংশের বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে জড়িত। সেই জায়গাটা একেবারে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, তা অনস্বীকার্য।