১১৫ কোটি টাকার শোভাবর্ধন প্রকল্পের বলি নরসুন্দা নদী
সাইফুল হক মোল্লা দুলু, কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এককালের খরস্রোতা নরসুন্দা নদী এখন দখল-দূষণের কবলে পড়ে বড় নালায় পরিণত হয়েছে। আবর্জনা ফেলে নদীকে বানানো হয়েছে ভাগাড়। অথচ মাত্র তিন বছর আগেই ‘নরসুন্দা নদী খনন ও শোভাবর্ধন’ প্রকল্পের নামে খরচ করা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। তবে তাতে কাজের নামে হয়েছে লাগামহীন দুর্নীতি আর অনিয়ম। এতে অপরিকল্পিত ওই প্রকল্পের সুফল দেখতে পাচ্ছে না এলাকাবাসী। এ ছাড়া উদ্ধার করা নদীর জমিও অভিনব পন্থায় ফের বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নদীর বর্তমান করুণ অবস্থা দেখে জেলাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে ১১৫ কোটি টাকায় ‘নরসুন্দা খনন ও শোভাবর্ধন প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এ প্রকল্পের অধীনে ছিল ৩২ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুই তীরে তিন কিলোমিটার পাড় বাঁধাইসহ দৃষ্টিনন্দন সেতু, পার্ক, ফুটপাত ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ। বরাদ্দকৃত টাকায় ৪টি ফুট ওভারব্রিজ, একটি বড় ব্রিজ, দুটি প্রধান সড়কের সার্বিক উন্নয়ন, লিংক রোড তৈরি ও গুরুদয়াল কলেজ অংশে মুক্তমঞ্চ বর্তমানে দৃশ্যমান।
প্রকল্প বাস্তবায়নের পর অভিযোগ ওঠে, অধিকাংশ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের মালপত্র ব্যবহার করেছে। নদী খননের ৩০ কোটি টাকার সিংহভাগ কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা যোগসাজশে লুটপাট করেছে। এদিকে তিন বছর পার না হতেই অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে, ওয়াকওয়েসহ অন্যান্য স্থাপনায় ফাটল দেখা দিয়েছে। কথা ছিল, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নদীতে পানিপ্রবাহ বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু পানিপ্রবাহ তো দূরের কথা, নদীটি বর্তমানে নালায় পরিণত হয়েছে। শুস্ক মৌসুমের শুরুতেই নদী পানিশূন্য। নদীতে প্রবাহ না থাকায় শহরের ড্রেনের পানি ঢুকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ উইমেন চেম্বারের সভাপতি ফাতেমা জহুরা বেগম ও কিশোরগঞ্জ নাগরিক অধিকার সুরক্ষা মঞ্চ নামে সামাজিক সংগঠনের আহ্বায়ক শেখ সেলিম কবীর বলেন, নরসুন্দা নদী খনন ও সৌন্দর্যবর্ধনের নামে লুটপাটের মহোৎসব হয়েছে বলেই মাত্র তিন বছরের মাথায় এসে নদীটি সরু নালায় এবং ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
পরিবেশবিদ অধ্যক্ষ শরীফ সাদী বলেন, নদী খননের প্রায় পুরো টাকা মেরে দেওয়ায় নদীর তলদেশের গভীরতা ও প্রশস্তের মাপ কিছুই ঠিক নেই। এক কথায় নকশা ও নদী দুই-ই চুরি হয়ে গেছে। নরসুন্দা এখন সরু নর্দমায় পরিণত হয়েছে। তাই বর্ষায় জলাবদ্ধতা ও শুস্ক মৌসুমে চরম দুর্গন্ধের শিকার হচ্ছে শহরবাসী। তিনি অভিমত দেন, এখনও সময় আছে, হোসেনপুর উপজেলার কাওনার বাঁধে স্লুইস গেট নির্মাণ করে ব্রহ্মপুত্রের মূল প্রবাহের সঙ্গে নরসুন্দাকে যুক্ত করা হলে নদীটি প্রাণ ফিরে পাবে।
কিশোরগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য আইনজীবী নাসির উদ্দিন ফারুকী বলেন, নরসুন্দা প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদাররা শুরু থেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় প্রকল্পটি যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল তা ১০ ভাগও পূরণ হয়নি। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
কিশোরগঞ্জ এলজিইডির বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম আমিরুজ্জামান বলেন, নরসুন্দা প্রকল্প সমাপ্তির পর একাধিক নির্বাহী প্রকৌশলী এখানে যোগদান করেছেন। আমি চার মাস হলো যোগদান করেছি। নরসুন্দা প্রকল্প সম্পর্কে শুনেছি, কাজের মান ভালো হয়নি। ওয়াকওয়ে ভেঙে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের
জামানতের টাকা আটক রেখে কিছু কাজ সমাধা করা হয়েছে।
পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, নদী খননের টাকার বড় অংশ আত্মসাৎ হয়েছে বলেই আজ নদীর এই অবস্থা। নিম্নমানের কাজের দায় এখন পৌরবাসীকে বহন করতে হচ্ছে। এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, নদীটি শহরবাসীর জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু সঠিকভাবে কাজ না হওয়ায় নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি এ জেলায় দায়িত্ব নিয়ে আসার পর কচুরিপানা পরিস্কার, ওয়াকওয়েতে নির্বিঘ্নে চলাচলের ব্যবস্থাসহ কিছু কিছু কাজ করেছি। আগে কি দুর্নীতি হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, প্রায় ৩৩ কিলোমিটার নদী খনন করার কথা ছিল তা করা হয়নি।