নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর উপপরিচালক (প্রশাসন) সিরাজুল ইসলাম ভূইয়ার বিরুদ্ধে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন ছাড়াই নিজের খেয়াল-খুশীমতো ৭ দিনের মধ্যে অন্তত ২ কোটি টাকা দিয়ে ৩টি গাড়ি কেনার অন্তরালে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে। বিআইডব্লিউটিয়ের এক কর্মকর্তা পরিচালকের এহেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবর অভিযোগ দাখিল করেছে ।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ-ভারতের নৌ প্রটোকলের অধীনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থের অব্যয়িত অর্থ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ২টি জিপ গাড়ী ক্রয় করেন পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। একটি নিশান এক্সট্রিল- ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৭১৫৬, অপরটি হোন্ডাই কোম্পানীর ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৭১৫৭। নিশান গাড়িটি বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ-এর নৌনিট্রা বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম ব্যবহার করলেও হোন্ডাই গাড়িটি পড়ে আছে বিআইডব্লিউটিএ-এর যানবাহনপুলের ধুঁলোরস্তুপে। আবার রাজস্ব খাতভুক্ত ৫২ আসন বিশিষ্ট একটি স্টাফ বাস পুরাতন দেখিয়ে বিক্রি করে তদস্থলে ৩০ আসন বিশিষ্ট একটি এসিযুক্ত মিনিবাস ৬৯ লাখ টাকায় ক্রয় করেও দুর্নীতি করেছেন।
ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকলের অধীনে কোন গাড়ির বরাদ্দ ছিলো না এবং গাড়ী কেনার বিষয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের কোন ছাড়পত্র বা পূর্ব অনুমোদন নেয়া হয়নি। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম নৌ-প্রটোকলের অধীনে অব্যয়িত অর্থ ফেরত দেয়া লাগবে বিধায় তড়িঘড়ি করে নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন না নিয়ে মাত্র ৭ দিন সময়ের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা দিয়ে দুটি জিপ গাড়ী ক্রয় করেন। গাড়ি কেনার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেন গত ২৩ জুন-২০২০ থেকে ৩০ জুন-২০২০ সময়ে মধ্যে । যেখানে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই সময় লাগে নুন্যতম ১ মাস, সেখানে এতো অল্প সময়ে কিভাবে গাড়িগুলো কেনা হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে বিআইডব্লিউটিএ-এর কর্মকর্তাদের অনেকেই বলেছেন এটা স্পষ্টতই দুর্নীতি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অব্যয়িত অর্থ ফেরত দেয়ার ভয়ে কোন প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন ছাড়া একক ক্ষমতাবলে গাড়ি দুটি ক্রয় করেন তিনি। তবে এই কর্মকর্তা গাড়ি ক্রয় করে এখন কিছুটা বেকায়দায় পড়েছেন ।নিজের অপরাধ ঢাকতে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন পুরোদমে।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে ‘বিআইডব্লিউটিএ’র উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ‘আমরা মন্ত্রনালয়ে চিঠি দিয়েছি গাড়ি কেনার জন্য। কিন্তু এখনো কোন অনুমোদন আমাদের দেয় নাই।’ তাহলে যে দুটি গাড়ি কিনেছেন সেটা কিভাবে কিনলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের অধিদফতরে অর্থ বছরের বাজেটে যে টাকা ছিল তা অনেকাংশ ব্যবহৃত হয়নি। তাই আমরা সেই টাকা থেকেই গাড়ি কিনে ফেলেছি।’
মন্ত্রনালয়কে অবগত না করে গাড়ি কেনা হল কিভাবে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, ‘এটা আমাদের ভুল হয়েছে। তবে কিছু দিনের মধ্যেই অনুমোদন নিয়ে নিব।’
এদিকে গত ২ জুন ২০২০ তারিখে বিআইডব্লিউটিএ ১৮.১১.০০০০-১৯/১৯৩৩ স্মারক এ নৌ প্রোটকলের অধীনে দুটি জীপ গাড়ি ক্রয়ের ছাড়পত্রের জন্য মন্ত্রনালয়ে চিঠি প্রেরণ করলে জবাবে ২৬ জুলাই ২০২০ অর্থাৎ ৫৪ দিন পরে নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয় টিএ শাখার উপসচিব আনোয়ারুল ইসলাম ১৮.০০-৩০/১ নং স্মারকে বিআইডব্লিউটিএ-এর সরঞ্জামাদি ক্রয়ের তালিকায় গাড়ির শূন্য পদ আছে কি না জানতে চান। তখন উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম স্বাক্ষর করে তার অধীনস্ত উপসহকারী প্রকৌশলী (যানবাহন)কে মার্ক করেন। কিন্তু নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় থেকে ছাড়পত্র বা অনুমোদন আসার আগেই অর্থাৎ ২৩ থেকে ৩০ জুন মাত্র ৬ দিনের মধ্যে জিপ গাড়ি দুটি কেনার সময় সরকার নির্ধারিত ওপেন টেন্ডার মেথড ‘ওটিএম’ পদ্ধতি অনুসরন করা হয়নি। এক্ষেত্রে তিনি ডিরেক্ট প্রকিউরম্যান্ট মেথড ‘ডিপিএম’ পদ্ধতিতে তা ক্রয় করেন। তবে সরকারী ক্রয় নীতির পরিপন্থি হওয়ায় এখনো এই গাড়ি দ’ুটির অনুমোদন মন্ত্রনালয় কর্তৃক গৃহীত হয়নি।
আবার, গত ২২ জুন ২০২০ বিআইডব্লিউটিএ-এর রাজস্বখাত থেকে একটি স্টাফ বাস ক্রয়ের ছাড়পত্রের জন্য মন্ত্রনালয়কে চিঠি দিয়ে ‘ডিপিএম’ পদ্ধতিতে ৩০ আসন বিশিষ্ট একটি মিনি এসিবাস ৭৯ লাখ টাকায় মাত্র ৪ দিন সময়ের মধ্যে ক্রয় করে ৩০ জুন ২০২০ এর মধ্যে বিল পরিশোধ করেন। যা গাড়ী ক্রয়ের যাবতীয় প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত তার অধীনস্ত যানবাহন শাখার কম্পিউটারে সংরক্ষিত তথ্য ও সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রমান পাওয়া যাবে।
এদিকে, নৌপরিবহন মন্ত্রনালয় থেকে ২৬ জুলাই ২০২০ প্রেরিত চিঠিতে বলা আছে অর্থ মন্ত্রনালয় কর্তৃক ৮ জুলাই ২০২০ তারিখে জারিকৃত পরিপত্রে আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সকল সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্বশাষিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ের আওতায় সকল প্রকার নতুন/প্রতিস্থাপন হিসেবে যানবাহন ক্রয় সম্পূর্নরূপে নিষেধ রয়েছে। তারপরেও ২০১৯-২০ অর্থবছরের একেবারে শেষ সপ্তাহে এসে কিভাবে সরকারের ২ কোটি টাকা খরচ করে এই কর্মকর্তা কিভাবে ৩টি গাড়ি ক্রয় করলেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানান প্রশ্ন। যেমন বিআইডব্লিউটিএ-এর বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত গাড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, এটা আবার মন্ত্রনালয়কে জানিয়ে সেখান থেকে ছাড়পত্র গ্রহণ করা, টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোটেশন অনুসারে গাড়ি বুঝে নেয়া এবং বিল পরিশোধ করা, হিসাবপত্র সংরক্ষণ করা ইত্যাদি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যদি এই রকম কোন অভিযোগ সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ বিষয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কাছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ‘বিআইডব্লিউটিএ’ থেকে গাড়ি কেনার জন্য অনুমোদন চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছিলেন কিন্তু আমরা কোন অনুমোদন দিই নি। এখন তারা যদি আমাদের না জানিয়েই গাড়ি কিনে ফেলেন তাহলে এখন সকল দায়দায়িত্ব তারা বহন করবেন।’
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ সচিব মুহাম্মদ আবু জাফর হাওলাদারের সঙ্গে তার অফিসে কক্ষে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। একাধিকবার মুঠোফোন খুদেবার্তা পাঠালেও তারও কোন জবাব পাওয়া যায়নি।