► গার্মেন্ট সেক্টরে এমন পরিস্থিতির জন্য দুর্বল নেতৃত্ব ও সমন্বয়হীনতাকে দুষছেন অনেকেই
► সরকারি বন্ধেও কারখানা খোলার হঠকারী সিদ্ধান্তে উদ্বেগ
► ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার পরামর্শ

গার্মেন্ট খোলার খবরে শনিবার যাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই আবার গতকাল ফিরে গেছেন নিজ নিজ বাড়িতে। কেন চরম ভোগান্তি আর স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে এসব মানুষের টানাহেঁচড়া করা হলো তা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে নিন্দার ঝড়। গতকাল শিমুলিয়া ঘাট থেকে তোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে ছুটি ঘোষণার মধ্যেই তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্তে নিন্দার ঝড় উঠেছে। কারখানা শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়ার কারখানা মালিকদের এমন সিদ্ধান্তে উদ্বেগ জানিয়েছে সচেতন মহল। তারা বলছে, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অবস্থানগত পার্থক্য সর্বোপরি সমন্বয়হীনতা সংশ্লিষ্ট সবাইকে মর্মাহত করেছে। সরকারের পাশাপাশি এই খাতের উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বও চরম দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অবস্থানগত পার্থক্যের কারণে এমন ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও অন্য নাগরিকদের মতোই সমান গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের দুর্বলতা ছিল। তারা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এখন সব পক্ষের সমন্বয় করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শ্রমিকদের মার্চ মাসের মজুরি পরিশোধ জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য পরে। সবাই এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। যাঁরা পরিচালনা করেন তাঁরা শ্রমিকদের জীবন নিয়ে মানবিক ছিলেন না। তাঁদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। আমি মনে করি শ্রমঘন এমন শিল্প এখনই জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা উচিত। একই সঙ্গে শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকশনএইডের এদেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির বলেন, ‘আমরা হতভম্ব! এমন ভুল হওয়া উচিত ছিল না। ভুল হয়েছে ঠিক আছে; এখন চাকরি বাঁচাতে বাড়ি থেকে শত বাধা ডিঙিয়ে ফিরে আসা শ্রমিকদের কী হবে? ১১ না ১৪ এপ্রিল কোন তারিখ কারখানা খুলবে—তা নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া এখন কোথায় যাবে শ্রমিকরা। তাদের এখনই থাকা-খাওয়া ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা উচিত।’
শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, পোশাক কারখানার মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ নেতারা পুরো বিষয়টি নিয়ে লুকোছাপা করছেন। বলা যায়, এ বিষয়ে সঠিক নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই গার্মেন্ট খাতে এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাঁদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তাঁরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শ্রমিকদের মার্চের মজুরি পরিশোধ ও তাদের থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করার দাবি জানান।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন কালের কণ্ঠকে বলেন, ২৫ তারিখ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ওই সময়টা ছিল মাসের শেষ। তার পরও তাঁরা খালি হাতে জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাড়ি ফিরে যান। আবার সরকারি ছুটি চলা সত্ত্বেও গত ৪ এপ্রিল ধারদেনা করে তাঁদের কারাখানায় আসতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু কারখানা না খোলায় তাঁরা আবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন।
রাজেকুজ্জামান রতন আরো বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর স্বেচ্ছাচারিতা ও সরকারের সমন্বয়হীতা দায়ী। তাঁরা শ্রমিকদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাঁদের জীবন ও জীবিকা চরম অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। আরেক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, কারখানা কবে খুলবে তা কেউ জানে না।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফ মিশু বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে সারা দেশ যেখানে লকডাউন; সেখানে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরিসহ ছুটি না দিয়ে উল্টো কাজে ডেকে এনে সীমাহীন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করা হয়েছে। এ জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বাণিজ্যমন্ত্রী দায়ী। তিনি সরকারের মন্ত্রী নন, গার্মেন্টের মালিক হিসেবে আচরণ করছেন। যত দিন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লকডাউন অবস্থা চলবে, তত দিন শ্রমিকদের মজুরিসহ ছুটির দাবি আমাদের।’
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, কারখানা খোলা ও বন্ধ রাখা নিয়ে মালিকপক্ষের এই লুকোচুরি খেলা খুবই ন্যক্কারজনক। তাদের এই আচরণে প্রমাণিত হয় তারা শ্রমিকদের জন্য শুধুই মায়াকান্না করে। প্রকৃত অর্থে তারা শ্রমিকদের অর্থ বানানোর যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এমন অমানবিক আচরণের জন্য তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল দিপু বলেন, এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য বিজিএমইএ দুঃখিত। বিজিএমইএ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই ২০ মার্চ শ্রম মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হয়। আর কারখানা বন্ধ করলেও অনেক কারখানাই বেতন দিয়ে বন্ধ করেছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ কারখানা ৭ মার্চের মধ্যে বেতন দেবে—এমন ঘোষণার ফলে শ্রমিকরা বেতন নিতে ফিরে এসেছেন। বিজিএমইএ আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে সব শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে কারখানার মালিকদের জানিয়ে দিয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে কারখানা আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সবাই যাতে মজুরি দিতে পারে তা তদারকির জন্য বিশেষ সেল খোলা হয়েছে। কোনো শ্রমিক ছাঁটাই না করারও আহ্বান জানানো হয়েছে।
নিন্দা-উদ্বেগ : পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত এবং শ্রমিকদের কারখানামুখী স্রোত করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির প্রত্যাশিত ফল পুরোটাই শঙ্কার মধ্যে পড়েছে উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে— ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিআইবি), আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট।
সংগঠনগুলো বলেছে, পোশাক কারখানার মালিকপক্ষের জাতীয় স্বার্থপরিপন্থী এই অবিবেচনাপ্রসূত স্বার্থপর আচরণে লাখ লাখ শ্রমিক এবং কার্যত গোটা দেশেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।