বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১২ চিন্তাবিদের মূল্যায়ন
রাশেদ মেহেদী

করোনা-উত্তর বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ হবে চীন। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে পড়তে হবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর নেতৃত্ব করোনা সংক্রমণজনিত সংকট মোকাবিলায় জারি করা জরুরি অবস্থাকেই শাসনের নতুন কৌশল হিসেবে বেছে নিতে পারেন। ফলে তৃতীয় বিশ্বে গণতন্ত্র নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। করোনাউত্তর বিশ্বজুড়ে সামাজিকতা ও সম্পর্কের নতুন বিন্যাস এবং অনলাইন নির্ভরতাও অনেক বেশি বাড়বে। বিরূপ প্রভাব পড়বে পর্যটন এবং অভিবাসনে।
করোনা-উত্তর বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে এমন মূল্যায়ন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১২ জন চিন্তাবিদের। এ বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘ফরেন পলিসি’র চলতি সংখ্যায়। এ ১২ চিন্তাবিদ হচ্ছেন- জন অ্যালেন, নিকোলাস বার্নস, লরি গ্যারেট, রিচার্ড হায়াস, কিশোরী মাহবুবানি, শিবশঙ্কর মেনন, রবিন নিবলেট, জোসেফ এস নাই জুনিয়র, করি শেক এবং স্টিফেন এম ওয়াল্ট।
পশ্চিম থেকে পুবে : কভিড-১৯ পশ্চিম থেকে প্রাচ্যে শক্তি ও প্রভাবের পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় সাফল্য চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত করবে। করোনায় বিপর্যস্ত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো আগামীতে নিশ্চিতভাবেই উৎপাদন, বিপণন, সম্প্রসারণ এবং নতুন বিনিয়োগ- সবদিক থেকেই সংকটে পড়বে। অথচ চীনের কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠেছে। ফলে ফাইভজির দুনিয়ায় চীনকে অনেক বেশি এগিয়ে রাখছে করোনা পরিস্থিতি।
এই বিচারে, এ মহামারি মার্কিনকেন্দ্রিক বিশ্বায়ন থেকে অর্থনীতিকে মূলত চীনকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের দিকে সরিয়ে নেবে। কারণ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অর্থনৈতিক নীতি আস্থা হারাতে শুরু করেছে। এতদিন যে অর্থনৈতিক মডেলকে বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভাবা হচ্ছিল, তার ভেতরের ভঙ্গুর অবস্থা এবার অনেকখানি উন্মোচিত হয়ে গেছে। এর বিপরীতে চীনের অর্থনৈতিক মডেল অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত হলেও দুঃসময়ে সেটি অনেক বেশি সুরক্ষিত করতে পেরেছে সাধারণ মানুষকে। ফলে করোনাউত্তর পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্যিক কৌশলের বিপরীতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভিও বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে- যা বাণিজ্যযুদ্ধে চীনকেই এগিয়ে রাখবে।
চীনের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরও করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধে ভালো সাফল্য দেখিয়েছে এবং এসব ক্ষেত্রে চীনের সহায়তা অনেক বেশি কাজে লেগেছে, যা ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র পারেনি। ফলে এশিয়ার আরও অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গ ছেড়ে চীনের ওপর নির্ভরশীল হতে থাকবে। ভবিষ্যতে চীন আরও বেশি কৌশলগত সহায়তা দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ও অগ্রগতির কেন্দ্র পশ্চিম থেকে সরিয়ে পুবের দিকে নিয়ে আসতে চাইবে।
রাষ্ট্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হবে : কভিড-১৯ মহামারি রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকারগুলো সংকট পরিচালনার জন্য নেওয়া জরুরি ব্যবস্থাকেই রাষ্ট্র পরিচালনার মডেল হিসেবে নিতে চাইবে। যে কারণে সংকট শেষে সামাজিক জীবন শুরু হলেও বিশ্বের অনেক দেশের রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক চেহারা কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে। এ ধরনের ঘটনা ইউরোপের একাধিক উন্নত অর্থনীতির দেশেও ঘটতে পারে।
করোনাউত্তর বিশ্ব পরিস্থিতিতে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রভাব কমে গেলে রাজনৈতিক প্রভাবও কমে আসবে। ফলে ইউরোপের গণতান্ত্রিক ভাবধারার রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার প্রভাবও কমবে। অনেক দেশের শাসক, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও অনেক আগে থেকেই আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী হওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তারা করোনা পরিস্থিতির উদাহরণ দিয়ে চীনের মতো নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারেন, যাতে জনসমর্থনও জুটতে পারে।
পর্যটন ও অভিবাসনে বিরূপ প্রভাব : করোনা পরিস্থিতিতে সরাসরি ক্ষতি হয়েছে পর্যটন শিল্পের। এক কথা, এ শিল্প এখন স্তব্ধ হয়ে গেছে এবং ধ্বংসের অপেক্ষায় আছে। কারণ করোনা পরিস্থিতির চরম সংকটজনক অবস্থা থেকে উত্তরণ কাটলেও এর ভীতিকর অভিজ্ঞতার রেশ আরও দীর্ঘ সময়জুড়ে থাকবে। মানুষ স্বভাবতই পর্যটনে কম উৎসাহিত হবে। আবার অনেক দেশ পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করবে।
এর ফলে ভিসা নীতিও আগের চেয়ে কঠিন হবে। নতুন শর্ত যোগ হবে। এই কঠিন নীতি ও শর্ত অভিবাসনের জন্য আরও বেশি প্রযোজ্য হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং উচ্চ প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল ছাড়া করোনাউত্তর পরিস্থিতিতে ইউরোপ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়বে। এমনকি এখন যারা শিক্ষা ভিসা ও অস্থায়ী ভিসায় স্বল্পমেয়াদি অভিবাসী হিসেবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, তাদেরও নিজের দেশে ফিরে যেতে হতে পারে অচিরেই। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ এখনও স্বল্প দক্ষ কিংবা অদক্ষ জনশক্তি দিয়ে বিশ্ব শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অভিবাসন সংকট। পর্যটন ও অভিবাসন সংকটকে চীনসহ এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটাও হয়ে উঠবে একটি বড় প্রশ্ন।
সামাজিকীকরণের নতুন বিন্যাস : করোনা মহামারি এরই মধ্যে ‘সামাজিক দূরত্ব’ এবং ‘বিচ্ছিন্নতা’ শব্দ দুটিকে বহুল ব্যবহূত শব্দে পরিণত করেছে এবং অচিরেই এগুলো সামাজিক জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অনুষঙ্গে পরিণত হতে যাচ্ছে। মানুষ এতদিন অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সামাজিকীকরণের জন্য ক্ষতিকর মনে করেছে। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণজনিত পরিস্থিতি মানুষকে ঘরবন্দি করার পর তার সামাজিক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমই হয়ে উঠেছে অনলাইন ব্যবস্থা। মানুষ মনের ভেতরের ভয় থেকে আগামীতে দীর্ঘ সময় সামাজিক অনুষ্ঠান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ভিড়-সমাবেশ, শপিংমল কিংবা সিনেমাহলে যাওয়া এমনকি গণপরিবহনে চড়াও কমিয়ে দেবেন।
এখন যেমন অনলাইনে দলবেঁধে গল্পগুজব হচ্ছে, ছবি দেখেই অনেক কিছুর শখ মেটানো হচ্ছে, সেটাই হয়তো আগামী দিনে সাধারণ জীবনযাপনের অংশ হতে যাচ্ছে। বিশেষত, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে যে ফাইভজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস প্রযুক্তি- সেগুলো তো মানুষকে বাস্তব জীবন থেকে ভার্চুয়াল জগতে আরও বেশি করে ঠেলে দেওয়ারই উপযোগী। কভিড-১৯ সে ব্যবস্থাটাকেই মানুষের মনের ভেতর পাকাপাকিভাবে ঢুকিয়ে দিল এক ধাক্কায়।
অতএব করোনাউত্তর পরিস্থিতিতে মানুষ ও মানব সভ্যতা সামাজিকীকরণের নতুন বিন্যাসে ভার্চুয়াল অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন এই ১২ চিন্তাবিদ।