তুষার কণা খোন্দকার

২০২০, মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে করোনা ভাইরাস তখন তার জন্মভূমি চীন ছেড়ে দুনিয়ার সব দেশ দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছে। আমরা বাংলাদেশের বাসিন্দারা তখনও করোনার ভয়াবহতা অনুমান করে উঠতে পারিনি। আমরা মহল্লাবাসী কেউ কেউ তখনও পার্কে দল বেঁধে হাঁটি। অনেক সচেতন প্রাতঃভ্রমণকারী মুখে মাস্ক পড়ে আবার আমার মতো অসচেতন যারা, তারা বিনা মাস্কে হাঁটতে আসে। সেই সময় একদিন পার্কের মূল ফটক পার হয়ে ভেতরে পা রাখতে দেখি মাঠের মাঝখানে বাসক ঝাড়ের গোড়ায় মুখ চেনা কিশোর ছেলেটি তার জরাজীর্ণ বল আর ব্যাট দিয়ে একা ক্রিকেট খেলা প্র্যাকটিস করছে। ছেলেটির সাথে আমার পূর্ব সখ্য আছে। আমি অনেক সময় তার সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মত বিনিময় করি। আমাকে দেখে কিশোর ছেলেটি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, পার্কের মানুষগুলার সমস্যা কি? দেখেন দেখি, হাটুন্নে (হাঁটতে আসা) মানুষগুলা গরুর মত মুখে টোনা লাগাইছে ক্যান? আমি ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে বললাম, টোনা বলতে তুমি কি বোঝাচ্ছ? তুমি কি মাস্কের কথা বলছ? কিশোর এতটুকু না ঘাবড়ে বেশ জোরের সাথে বলল, আমি কিছুদিন পরপর আমার মার সাথে গ্রামে নানাবাড়ি যাই। আমার নানা রোজ সকালে তার গরুগুলার মুখ টোনা দিয়া ঢাকা দিয়া মাঠে নিয়া যায়। আমার নানায় কয়, গরুর মুখে টোনা না দিলে গরু খালি মানুষের ক্ষেতে মুখ দেয়। এরপর ছেলেটি গরুর মুখের টোনা নিয়ে তার অনেক রকম অভিজ্ঞতার কথা বললেও আমি তখন ভাবছিলাম ভিন্ন কথা। আমার মনে হয়েছিল, গরুর পেটে ক্ষুধা থাকে বলে সে খাবারের সন্ধান করে। যেখানে খাবার পায় সেখানেই মুখ ডুবিয়ে সে খেতে চায়। গরুর পক্ষে জমি কিংবা ফসলের মালিকানা তত্ত্বতালাস করে নিশ্চিত হয়ে পেটের ক্ষুধা মিটানো সম্ভব নয়। কাজেই গরুর মালিক বিবাদ এড়ানোর জন্য গরুর মুখে টোনা পড়িয়ে দেয়। কিন্তু মানুষ নামের দোপেয়ে প্রাণী কি পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য খায় নাকি পেটের ক্ষুধা মিটে যাওয়ার পরে শুরু হয় তাদের আসল শয়তানি। মানুষ তখন মনের লালসা মিটানোর জন্যহিংস্রভাবে খাই খাই করে ফেরে। দুনিয়াজোড়া লোভী মানুষের পাল জমি খায়, নদী খায়, সাগর কিংবা আকাশও তার খাই খাই থেকে রেহাই পায় না। প্রকৃতির প্রতি মানুষের হিংস্র আচরণের শেষ নেই, সীমা নেই। সে জন্য বোধ হয় প্রকৃতি মানুষের মুখে মাস্ক এঁটে দিয়েছে। মানুষকে ঘরে বন্দি করে সৃষ্টির অন্য জীবেরা কিছুদিন প্রানভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে।
মানুষের খাই খাই আমাদের দেশের সীমায় আটকে আছে তা কিন্তু নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো মানুষের ভোগের লিপ্সাকে পুঁজি করে খাই খাই খাসলতের চূড়ান্ত করে ছেড়েছে। ভোগবাদী দুনিয়ার পণ্যের জোগান দিতে গিয়ে তারা বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে দুুনিয়াটাকে বাসের অযোগ্য করে ফেলেছে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মারা যাওয়ার আগে বলে গেলেন ‘পৃথিবী নামের গ্রহটি বাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। মানুষকে বাঁচতে হলে বসবাসের জন্য আরেকটি গ্রহের সন্ধান অত্যন্ত জরুরি।’ রাজনীতিবিদেরা পৃথিবী নামের গ্রহটির নিয়ন্তা। ক্ষমতার লোভে মজে গিয়ে উনারা নিজ হাতে পৃথিবী নামের গ্রহটিকে বাসের অযোগ্য করে ফেলেছেন। ক্ষমতার ভাবনায় মুখ ডুবিয়ে থাকার কারণে উনারা পৃথিবীর পরিণামের দিকে চোখ তুলে চেয়ে দেখার সময় পাননি। বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্ষমতাধর রাজনীতিকেরা পৃথিবী ধ্বংস করার জন্য মারণাস্ত্র বানানো আর সেটি বেচাবিক্রির কাজে এমন ব্যস্ত ছিলেন যে নিজ দেশের স্বাস্থ্য খাতের দিকে চোখ তুলে চেয়ে দেখেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উন্নত দুনিয়ার প্রতিটি দেশ ভয়ানক মারণাস্ত্র বানানো আর বেচার কাজে এমনই ছিল্লি দেওয়ানা হয়ে আছে যে নিজ নিজ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে মনোযোগ দেওয়ার কথা একবারও তাদের মাথায় আসেনি। দুনিয়ার নানান জায়গায় সার্স ১, সার্স ২, মার্স এবং ইবোলা আক্রমণ হওয়ার পরে অনেক বিজ্ঞানী বলেছেন পৃথিবী যে কোনো সময় ভয়ঙ্কর কোন জীবাণুর মুখোমুখি হবে যা একযোগে সারা পৃথিবীকে আক্রান্ত করে ফেলতে পারে। বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু একযোগে অনেকগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়াটা আরেকটি অশনি সংকেত ছিল। সব দিক বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সব দেশকে তাদের স্বাস্থ্য খাতের দিকে আরও মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পৃথিবীর উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো মারণাস্ত্রসহ নিত্যব্যবহার্য যন্ত্রপাতির উন্নত সংস্করণ বাজারে ছাড়ার জন্য কত টাকা খরচ করে সেটা আমাদের কল্পনায়ও আসে না। বিজ্ঞানীরা অণুজীব নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার বলে ক্লান্ত হয়ে গেলেও সেদিকে কোনো রাজনীতিককে এতটুকু মনোযোগী হতে দেখা গেল না। উন্নত দুনিয়া তাদের নিজ দেশের স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি কিংবা অণুজীব বিষয়ে গবেষণায় কতটুকু মনোযোগ দিয়েছিল সেই সত্য মাত্র তিন মাসের করোনা ঝড়ে সবার চোখে উন্মোচিত হয়ে গেছে।
পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো নিজেদেরকে ঈশ্বর বলে ভাবতে ভালোবাসে। কারণ তাদের ভাণ্ডারে এমন সব অস্ত্র আছে যা এই পৃথিবীকে অনেকবার ধ্বংস করে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। পরমাণু অস্ত্রধারী দেশগুলো ভাবে ধ্বংসের দামামা বাজাতে পারলেই ঈশ্বর হওয়া যায়। সমরাস্ত্রের বেসাতি করা বেওয়াকুফ দেশগুলো গত সাত দশক ধরে স্রষ্টার হাতে তৈরি পৃথিবীটা রক্ষণাবেক্ষণের কথা ভাবল না। এখন করোনার ঝড়ে দুনিয়াজোড়া ধনী-গরিব সব দেশের অর্থনীতির চাকা থমকে যাওয়ায় শক্তিধর দেশগুলো নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকা দেবার জন্য দোষাদুষির খেলায় মেতে উঠেছে। ইজরাইলের ইতিহাসবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নোয়া ইউভাল হারারি বলেছেন, মানুষ যখন ঈশ্বর সৃষ্টি করল, তখন সভ্যতার সূচনা। মানুষ নিজেই যখন ঈশ্বর হয়ে যাবে তখন এই সভ্যতার অবসান হবে। করোনা সংকট নিয়ে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক হারিরিতাঁর বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য দিয়ে সুধি সমাজের প্রশংসা পেয়েছেন।তিনি বলেছেন, করোনা কোন সংকট নয়। একটি অণুজীব শক্তিশালী হয়ে মানুষকে আক্রমণ করেছে বলে মানুষ পরাজিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে সেটা মোটেও সত্য নয়। কিন্তু মানুষের সমাজে এখন ঘৃণা-বিদ্বেষ-লোভ-ক্ষমতার রাজত্ব চলছে। কাজেই বিভেদের সমাজে কলুষিত পরিবেশে করোনা সবল এবং মানুষ দুর্বল এই সত্য এখন মানুষকে মেনে নিতে হবে। অধ্যাপক হারিরির মুখের কথা মুখেই রয়ে গেছে। এর মধ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেবের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাণ্ডগুলো দেখুন। করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে ট্রাম্প সাহেব করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তুতি না নিয়ে বরং করোনা ছড়ানোর জন্য চীনকে দায়ী করে ইচ্ছামাফিক কটূক্তি করে করে সময় নষ্ট করতে লাগলেন। ট্রাম্প এবং ট্রাম্পের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও বোধ করি কূটনৈতিক শিষ্টাচার শব্দের সাথে আদৌ পরিচিত নন। কোনো রকম তথ্য প্রমাণ ছাড়া তিনি ক্রমাগত বলতে থাকলেন, উহানের ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি দুনিয়াকে নাকাল করার জন্য করোনা নামের জীবাণু পয়দা করে দুনিয়াজোড়া ছড়িয়ে দিয়েছে। আমেরিকার বিদ্বেষপূর্ণ অভিযোগের কারণে আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশে চীনা বংশোদ্ভূত মানুষগুলো আক্রমণের শিকার হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী করোনা দুর্যোগের সময় ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চাঁদার টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, ট্রাম্প মনে করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের প্রতি পক্ষপাত দেখায়। কাজেই তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। ট্রাম্পের এমন দায়দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ অধ্যাপক হারিরি সাহেবের আশঙ্কাকে সত্যে পরিণত করল। করোনা নয়, পৃথিবীর বুকে এখন বিভেদ এবং বিভাজনের রাজত্ব। কূটনীতির যুদ্ধ চীন এবং আমেরিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনা সারা পৃথিবীর কূটনীতির ডিএনএ বদলে দিতে শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইতালি হাজার হাজার করোনা রোগী নিয়ে একলা একা যুদ্ধ করতে গিয়ে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পন করেছিল। ইতালির প্রধানমন্ত্রী অসহায় হয়ে বলেছিলেন, আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আমাদের সাধ্য অতিক্রম করে গিয়েছি কিন্তু করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। অলৌকিক কিছু ঘটার জন্য এখন আমরা আকাশের দিকে চেয়ে আছি।’ ইটালির ভয়ঙ্কর দুর্দশার সময় ইউরোপের অন্যান্য দেশ তাদের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় ইটালি ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি না সেটি নতুন করে ভেবে দেখবে।
করোনার আক্রমণে পৃথিবীর বহু দেশে লাশের মিছিল। এর মধ্যে দুনিয়াজোরা লকডাউনের ফলে উৎপাদন এবং বাণিজ্যের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে। বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ করে করোনার বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করতে না পারলে সভ্যতা এবার বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী
– দৈনিক সমকালের সোজন্যে