সম্মুখযুদ্ধ শুরুর তৃতীয় দিনেই স্বাধীন বাংলার আকাশ শত্রুমুক্ত হতে শুরু করে। যৌথবাহিনীর কাছে বিপর্যস্ত হতে থাকায় জেনারেল নিয়াজি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সীমান্ত অঞ্চল ছেড়ে শহরভিত্তিক স্ট্রং পয়েন্ট তৈরির নির্দেশ দেন। একাত্তরের এই দিনে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশে পাকবাহিনীর প্রায় সব বিমান। ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো সারা দিন ধরে অবাধে আকাশে উড়ে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো। ভারতের বিমানবাহিনীর হিসাব মতে, ১২ ঘণ্টায় ২৩২ বারে তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে ৫০ টনের মতো বোমা ফেলা হয়। পাক বাহিনীর কনভয়ের ওপর ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর ৯০টা গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়াও পাকবাহিনীর সেনাবোঝাই কয়েকটা লঞ্চ ও স্টিমার ধ্বংস হয়।
সাবমেরিন ‘পিএন গাজী’ ছিল পাক নৌবহরের গর্বের বস্তু। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথকমান্ডের সফল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার হিসেবে পেয়েছিল। একাত্তরের এই দিনে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের পরামর্শ দেয়। তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও তাদের অপারগতা প্রকাশ করে। বিশ্বের সব দেশ বুঝতে পারে বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার ক্ষমতা আর পাক বাহিনীর নেই। এদিকে লে. আরেফিনের নেতৃত্বে চালনা নৌ বন্দরে বড় ধরনের আক্রমণ পরিচালিত হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীসহ সব সেনা বন্দর ত্যাগ করে। কোস্টাল গানসহ প্রচুর গোলাবারুদ হস্তগত হয় মুক্তিবাহিনীর।
ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি আমীর হোসেন, লেফট্যানেন্ট বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমীন, সিপাহি সাহাব উদ্দীন, সিপাহি মুস্তাফিজুর রহমান শহিদ হন। আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর কিছু পাকসেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পালিয়ে যাওয়ার সময় মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
একাত্তরের এই দিনে মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়েও মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তর সেদিনও ছিল উত্তপ্ত। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ব দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও দেখতে পাচ্ছিলেন। আগের দিন নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব আনার প্রেক্ষাপটে ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান ঘটবে। এ প্রস্তাবে পোল্যান্ড সমর্থন দেয়। যথারীতি ভেটো দেয় চীন। অন্যরা বিরত থাকে ভোট দানে।
এ সময় জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া জোর দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের উচিত পাকিস্তানের ওপর ভারতীয় হামলার তীব্র নিন্দা করা। তিনি পাকিস্তান থেকে অবিলম্বে বিনা শর্তে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানান। চীনা প্রতিনিধি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যৌক্তিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান ও অস্বীকার করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ইঙ্গিত করে জোর দিয়ে বলেন, ভারত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে আগ্রাসি তত্পরতা চালাচ্ছে। এদিনই চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত অবস্থা চিন্তিত করে তোলে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে। কারণ এদিনও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এদিকে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব শ্রী কেবি লাল ‘বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা’ উল্লেখ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়াটা শুধু সময়ের ব্যাপার বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে দুর্বল না করে তোলে তাই তাদের মনোবল বাড়াতে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী জাতির উদ্দেশ্যে বেতারে ভাষণ দেন।
এদিকে ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পুতুল শাসক গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন, দেশ আক্রান্ত। ভারতীয়দের সহযোগিতায় কিছু বিশ্বাসঘাতক দেশ আক্রমণ করেছে। এ দেশের সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করছে। তাদের সাহায্য করার জন্য প্রতিরক্ষা তহবিল করা হয়েছে। সে তহবিলে মুক্তহস্তে সাহায্য করার জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। তার আহ্বানে কেউ যে এগিয়ে আসেনি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।