নিজস্ব প্রতিবেদক :
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিকৃত লালসার শিকার হয়ে অকালে প্রাণ দিয়েছে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়া। মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনা নানা রহস্যের জন্ম দিয়েছে। গুলশানের লাখ টাকা ভাড়ার বাসায় ওই কলেজছাত্রী একাই থাকতেন। ঘটনার পর তার পরিবারের দায়ের করা মামলায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে। মামলা দায়েরের পর আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত। ঘটনার পর আনভীরের সঙ্গে মুনিয়ার অন্তরঙ্গ ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ওই তরুণীর সঙ্গে আনভীরের কি সম্পর্ক ছিল। মুনিয়া আত্মহত্যা করে থাকলে কেন করেছেন।
নাকি অন্য কোনো কারণে তার মৃত্যু হয়েছে এমন নানা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে গতকাল দিনভর। এ ঘটনায় বসুন্ধরা এমডিকে আসামি করা হলেও গতকাল পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। বসুন্ধরা গ্রুপও এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি।

পুলিশ ও তদন্ত সূত্র জানায়, গুলশানে মুনিয়ার ভাড়া বাসার দেওয়ালে টানানো ছিল আনভীর ও মুনিয়ার যৌথ অনেক ছবি। ওই বাড়ির মালিক আয়োজিত ২৩শে এপ্রিলের ইফতার পার্টিতে তোলা মুনিয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন বাড়ির মালিকের মেয়ে। ওই ছবি নজরে পড়ে সায়েম সোবহান আনভীরের মায়ের। মুনিয়ার বাসা থেকে জব্দ করা ডায়রিতে পাওয়া গেছে তার সর্বশেষ লেখা। ছয়টি ডায়রিতে নিজের ভালোবাসা, বিষাদ ও যন্ত্রণার কথা লিখেছেন মুনিয়া। উল্লেখ করেছেন ‘জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের’। তারপরই সোমবার সন্ধ্যার পর গুলশান-২-এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাড়ির ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে ওই দিন রাতে গুলশান থানায় মামলা করেছেন মুনিয়ার বড় বোন ব্যাংক কর্মকর্তা নুসরাত জাহান। মামলায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে। পুলিশ ইতিমধ্যে ২৩শে এপ্রিল থেকে ২৬শে এপ্রিল পর্যন্ত সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী, বাড়ির মালিক, মালিকের জামাতা ইব্রাহিম আহমেদ রিপন ও তার স্ত্রীকে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে মডেল হিসেবে পরিচিত ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী মানবজমিনকে বলেন, ওই বাসায় আনভীরের যাতায়াত ছিল কিনা তা নিশ্চিত হতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অন্য কেউ ওই বাসায় ঘটনার আগে গিয়েছিল কিনা তাও তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়াও নিহত মুনিয়ার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলেই তার মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এই ঘটনায় আনভীর বা অন্য কারও প্ররোচনার প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। ডিসি সুদীপ চক্রবর্তী জানান, এ ঘটনার মামলার পরপরই সায়েম সোবহান যাতে দেশ ছাড়তে না পারেন এজন্য অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
এদিকে, গুলশান-২-এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাড়িতে গেলে কথা হয় নিরাপত্তারক্ষী আব্দুল কুদ্দুসের সঙ্গে। তিনি জানান, গত ২২, ২৩শে এপ্রিল পরপর দু’দিন ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন সায়েম সোবহান আনভীর। ফ্ল্যাট বি-৩ থাকতেন মুনিয়া। বাসাটি গত ১লা মার্চ দুই বছরের জন্য ভাড়া নেন মুনিয়া। মুনিয়ার নামে ভাড়ার চুক্তি থাকলেও সংশ্লিষ্টরা জানান বাড়ির মালিকের মেয়ের জামাতা ইব্রাহিমের কাছে প্রতি মাসে ভাড়া ১ লাখ ও সার্ভিস চার্জ ১১ হাজারসহ ১ লাখ ১১ হাজার টাকা অন্য কেউ পাঠাতেন।

মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান জানান, তার বোন মিরপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ঢাকায় থাকাকালেই আনভীরের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রায়ই ফোনে কথা হতো। দেখা হতো বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। ২০১৯ সালে স্ত্রী পরিচয়ে বনানীর একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মুনিয়াকে নিয়ে থাকতেন আনভীর। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনভীরের পরিবার বিষয়টি জানতে পারে। ওই সময় ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে দিয়ে মুনিয়াকে নিজেদের বাসায় ডেকে নেন আনভীরের মা। বাসায় নিয়ে তাকে হুমকি-ধমকি দেন। আনভীরের সঙ্গে মেলামেশা করলে পরিণতি হবে কঠিন। শর্ত দেন বেঁচে থাকতে চাইলে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
পুলিশ ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ওই সময়ে আনভীরও তাকে কুমিল্লা চলে যেতে বলেন। ওই সময়ে করোনার প্রকোপ দেখা দেয়। অবস্থা প্রতিকূল দেখে ঢাকা ছেড়ে কুমিল্লা চলে যান মুনিয়া। এরমধ্যে আবার আনভীর তাকে ডাকেন। বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেন। যেহেতু তার পরিবার এটি মানছে না তাই বিয়ে করে বাইরের কোনো দেশে মুনিয়াকে সেটেল করবেন বলে জানান। এক পর্যায়ে গত ১লা মার্চ গুলশানের ওই বাসা দুই বছরের জন্য ভাড়া নেন মুনিয়া। সম্পর্ক ভালোই চলছিল তাদের। প্রায়ই ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন আনভীর। দেয়ালে ঝুলানো ছিল তাদের অন্তরঙ্গ বিভিন্ন ছবি। কিন্তু মুনিয়াকে নিয়ে বাইরে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতেন না আনভীর। গত ২৩শে এপ্রিল ওই বাড়ির মালিকের বাসায় ছিল ইফতার পার্টি। ওই পার্টিতে গিয়েছিলেন মুনিয়া। সেসব ছবি ফেসবুকে আপলোড করেন বাড়ির মালিকের মেয়ে। এটি নজরে পড়ে পিয়াসার। পিয়াসার মাধ্যমে জানতে পারেন আনভীরের মা। এ নিয়ে আনভীরের সঙ্গে কথা হয় তার মায়ের। তারপর আনভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুনিয়ার ওপর। এ বিষয়ে মামলার এ জাহারে মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান উল্লেখ করেছেন, মুনিয়া তাকে ফোন করে বলেছে আনভীর তাকে বকা দিয়েছেন। বলেছেন, মুনিয়া ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছে কেন, কেন ছবি তুলেছে। এসব ছবি ?পিয়াসা দেখেছে। পিয়াসা তার (আনভীর) মাকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। এজাহারে বলা হয়, আসামি মোসারাতকে বলে, তিনি দুবাই চলে যাচ্ছেন, সে যেন কুমিল্লায় চলে যায়। আসামির মা জানতে পারলে তাকে (মুনিয়া) মেরে ফেলবেন। এজাহারে নুসরাত আরো উল্লেখ করেছেন, দু’দিন পর ২৫শে এপ্রিল মুনিয়া তাকে ফোন করেন। ওই সময় কান্নাকাটি করে মুনিয়া বলেন, আনভীর তাকে বিয়ে করবেন না, শুধু ভোগ করেছেন।
মুনিয়া তাকে আরো বলেছেন, আনভীর বলেছেন, মুনিয়া তার শত্রুর সঙ্গে দেখা করেছেন। মুনিয়াকে তিনি ছাড়বেন না। মুনিয়া চিৎকার করে বলেন, আসামি তাকে ধোঁকা দিয়েছে। যেকোনো সময় তার বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তারা (বাদী নুসরাতের পরিবার) যেন দ্রুত ঢাকায় আসেন।
আত্মীয়স্বজন নিয়ে মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত বেলা দুইটার দিকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় রওনা দেন। আসার পথে বারবার মুনিয়ার ফোনে কল করেন। কিন্তু তিনি আর ফোন ধরেননি। গুলশানের বাসায় পৌঁছে দরজায় নক করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে নিচে নেমে আসেন। তারা নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ থেকে বাসার ইন্টারকমে ফোন করেন। পরে ফ্ল্যাটের মালিকের নম্বরে ফোন দিলে মিস্ত্রি এনে তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার পরামর্শ দেন। মিস্ত্রি ডেকে তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর তিনি দেখেন, তার বোন ওড়না প্যাঁচিয়ে শোয়ার ঘরের সিলিংয়ে ঝুলে আছেন। এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, পুলিশ এসে ওড়না কেটে মুনিয়ার লাশ নামায়। আলামত হিসেবে আসামির সঙ্গে ছবি, আসামির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে লেখা ডায়েরি ও তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইলফোন জব্দ করে পুলিশ। জানা গেছে, মুনিয়ার সঙ্গে সর্বশেষ তার বোনের কথা হয়েছে সকাল সাড়ে ৯টায়। ওই ঘটনার আগে আনভীরের সঙ্গে ফোনে উত্তপ্ত কথা হয় মুনিয়ার। এরকম একটি অডিও রেকর্ড ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এতে মুনিয়াকে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন আনভীর। এমনকি তাকে অকথ্য ভাষায় গালি দেন তিনি। পুলিশ সূত্র বলছে, আসামির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় ২৬শে এপ্রিল সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে মুনিয়া মারা যান। ওই বাসা থেকে ছয়টি ডায়েরি জব্দ করেছে পুলিশ। একটি ডায়েরিতে তার সর্বশেষ লেখা পাওয়া গেলেও এতে তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। এতে লেখা রয়েছে, ‘আনভীরের সঙ্গে প্রেম করা আমার ভুল ছিল। বিবাহিত ও বাচ্চার বাবার সঙ্গে প্রেম করা ঠিক হয়নি। তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছাড়া বিয়ে হয় না। আনভীরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আনভীর আমাকে ভুল বুঝেছে। তাই আমি জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাল এসে আনভীর তার ভুল বুঝতে পারবে।’
তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট মুনিয়া। বাবা শফিকুর রহমান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। তাদের বাড়ি কুমিল্লার উজির দিঘিরপাড়। মা কাজী সেতারা বেগম ছিলেন ব্যাংকার। গত তিন বছর আগে মা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে এবং বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কুমিল্লা সদরে তাদের বহুতল বাড়ি এবং নিজস্ব মার্কেট রয়েছে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে তাদের দু’বোনের পারিবারিক কিছুটা দূরত্ব রয়েছে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে বড় বোন নুসরাত জাহান এবং বোন জামাই মো. মিজানুর রহমানের তত্ত্বাবধানে পড়ালেখা করতেন মুনিয়া। বোন জামাই মিজানুর রহমান চাঁদপুরে অবস্থিত একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা। মুনিয়া মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা স্কুল থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন। গত বছর (২০২০) এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও দিতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসএসসিতে পড়াকালীন মিরপুরে ছাত্রী হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করতেন মুনিয়া।
মুনিয়ার একজন আত্মীয় গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, মুনিয়ার ডায়েরিগুলো পড়ে মনে হয়েছে সে আত্মহত্যা করেনি। বাসার দরজা ভেঙে দেখা যায় তার মৃতদেহ বিছানার উপর হাঁটুভাঙা অবস্থায় ঝুলছিল। দু’পায়ের ঠিক মাঝে ছিল একটি টুল। এ ছাড়া গলায় এবং মুখে খুব গভীর কালসিটে দাগ দেখা গেছে। যে কক্ষের বিছানায় তাকে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে সেই বিছানাও ছিল খুব পরিপাটি। এবং গোছানো। যেগুলো দেখে মনে হওয়ার কথা নয় সে আত্মহত্যা করেছেন। তার লেখা ডায়েরিগুলো এতোটাই পরিপাটিভাবে লেখা ছিল যেখানে পৃষ্ঠা এগারো পড়ে দেখবেন প্লিজ! ৯২তম পৃষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আছে এভাবে সে পর্যায়ক্রমে মার্ক করে ডায়েরি লিখেছে।

ঘটনার একদিন আগে মুনিয়ার বোন জামাই তাকে মুঠোফোনে কিছু টাকাপাঠিয়েছিলেন। এটাই ছিল বোন জামাইয়ের সঙ্গে তার সর্বশেষ যোগাযোগ। ওই আত্মীয় জানান, মুনিয়ার জন্য পারিবারিকভাবে বিয়ের জন্য পাত্র দেখছিলেন তার পরিবার। কিন্তু আনভীরের জন্য মুনিয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয়। ওই আত্মীয়ের দাবি মুনিয়া ছিলেন খুব ধর্মপরায়ণ। তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
বসুন্ধরা এমডি’র দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা: রাজধানীর গুলশানে কলেজছাত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে করা মামলার আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভিরের বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. শহিদুল ইসলামের আদালত গতকাল এ নিষেধাজ্ঞা দেন। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনুমতি চাওয়া হয়েছে। আসামি যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সেজন্য অভিবাসন কর্তৃপক্ষকেও অনুরোধ করা হয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যার পর গুলশান-২-এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান (মুনিয়া) নামের এক তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ওই তরুণীর বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ১৮৬০ সালের দ-বিধির ৩০৬ ধারায় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহানকে মামলায় আসামি করা হয়। মামলা নম্বর-২৭। ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সুফিয়ান মোহাম্মদ নোমান মামলার এজাহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৩০শে মে দিন ধার্য করেন। ওদিকে আদালত থেকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও ইতিমধ্যে বসুন্ধরার এমডি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা ছিল। তবে গতকাল রাতে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা এই তথ্য নিশ্চিত করেননি।

ফেসবুক লাইভে যা বললেন মুনিয়ার বড় বোন
মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) রাতে ফেসবুক লাইভে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান মুনিয়া ঘটনার দিন ফোন করে বলছিল, ‘আপু তোমরা কখন আসবা, আমার অনেক বিপদ।’
নুসরাত জাহান জানান, মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) মুনিয়ার কুমিল্লায় চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগের দিনেই বিপদের কথা ফোনে জানতে পারি। এসময় কান্নাজরিত কণ্ঠে নুসরাত জাহান বলেন, আমরা যখন গুলশানের ফ্ল্যাটে ছুটে যাই, দেখি ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। ঐসময় ফোনও বন্ধ ছিল মুনিয়ার। পরে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করি আমরা। দরজা ভাঙ্গতে গিয়ে এতো জোরে শব্দ হচ্ছে অথচ ভিতর থেকে কোনো শব্দ হচ্ছিল না। নুসরাত জাহানের ভাষায়, এসময় আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। দরজা ভেঙ্গেই দেখি ঝুলন্ত অবস্থায় মুনিয়া। পা দুটি বিছানায়, হালকা বাঁকানো ছিল। বিছানা একদম পরিপাটি ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ সেট করে রেখে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে। মুনিয়ার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল কখন এর উত্তরে নুসরাত জাহান জানান, সোমবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ মুনিয়ার সাথে সর্বশেষ কথা হয়।
নুসরাত জাহান আরো জানান, তার বোনকে বিয়ের আশ্বাস দিয়েছিল অভিযুক্ত শিল্পপতি। কিন্তু বিষয়টা গোপণ রাখতে হবে এ শর্ত দেওয়া হয়েছিল মুনিয়াকে। এমনকি বিয়ের পরও বিষয়টি গোপণ রাখার কথা ছিল।
গুলশানের ফ্ল্যাটের বিষয়ে নুসরাত জাহান বলেন, ফ্ল্যাটের বিষয়টি আমরা জানতাম। আমরা মুনিয়াকে নিষেধও করেছি। কিন্তু মুনিয়া সরল মনে সব বিশ্বাস করেছে। ঐ শিল্পপতির প্রতি সে বিশ্বাসই কাল হলো এখন। এছাড়া ডায়েরির বিষয়ে বড় বোন বলেন, ডায়েরিতে অনেক ছবি আঁকা, আঁকার সাথে সাথে তাদের সম্পর্ক নিয়েও অনেক কথা ছিল। সকল ডকুমেন্ট পুলিশের হেফাজতে আছে। এসময় নুসরাত জাহান জোর গলায় বলেন, এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যাকা-। এর সুষ্ঠু তদন্ত চান তিনি।
কুমিল্লার মনোহরপুরের উজির দীঘির দক্ষিণপাড় এলাকার বাসিন্দা মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি সফিকুর রহমানের মেয়ে মোসারাত জাহান মুনিয়া রাজধানীর মিরপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। এবার এ প্রতিষ্ঠান থেকে তার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। এর আগে সে কুমিল্লা নগরীর বাদুরতলা এলাকার ওয়াইডব্লিউসিএ নামক একটি স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে। পরে সে নগরীর নজরুল এভিনিউ এলাকার মডার্ন হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে এবং সর্বশেষ রাজধানীর মিরপুর মনিপুরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে। পরিবারে এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে সবার কনিষ্ঠ।
হুইপপুত্র শারুনকে জিজ্ঞাসাবাদ
রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের পর আত্মহত্যায় প্ররোচনা মামলার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া হুইপপুত্র শারুন চৌধুরীর সঙ্গে মুনিয়ার কিছু কথোপকথনের স্ক্রিনশটের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। শারুন সাংবাদিকদের বলেছেন, তার কাছে মুনিয়ার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি জানান, মুনিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। গত বছর মুনিয়া ফেসবুকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনিই তাকে জানান, অভিযুক্ত শিল্পপতি সঙ্গে তার সাবেক স্ত্রীর সম্পর্ক হয়েছে। তবে শারুনের দাবি, মুনিয়ার মৃত্যুর পর ফেসবুকে তার সঙ্গে কথোপকথনের যে স্ক্রিনশট ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলো মিথ্যা।
ছড়িয়ে পড়া স্ক্রিনশটে কথোপকথন কত তারিখের, তা স্পষ্ট নয়। সময় বিকেল পাঁচটা বাজার কিছু আগে। খুদে বার্তার ওই কথোপকথনে মুনিয়া শারুনকে লেখেন, তিনি ভালো নেই। এরপর লেখেন, ‘উনি তো আমাকে বিয়ে করবে না। কী করব আমি?’ জবাবে শারুন লেখেন, ‘আগেই বলেছিলাম, ওর কথা শুইনো না। ও আমার বউকে বলছে বিয়ে করবে, কিন্তু করে নাই। মাঝখানে আমার মেয়েটা মা ছাড়া হয়ে গেছে।’

ঢাকায় পড়তে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন মুনিয়া
কুমিল্লা থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজধানী ঢাকায় গিয়ে অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়া। মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মুনিয়ার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে ওই কলেজ ছাত্রীর মরদেহ কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও এলাকায় তার বড় বোনের বাসায় নিয়ে আসা হয়।
এসময় উৎসুক মানুষ বাসাটির আশপাশে ভিড় জমায়। এতে সেখানে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এদিকে মঙ্গলবার বাদ আসর তার মরদেহ নগরীর টমছমব্রিজ কবরস্থানে দাফন করা হয়। মুনিয়া নগরীর মনোহরপুর এলাকার উজির দীঘির পাড়ের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত সফিকুর রহমানের মেয়ে। এ ঘটনায় এলাকার বিভিন্ন মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এদিকে পুলিশ কর্তৃক ওই কলেজছাত্রীর মরদেহ উদ্ধারের পর তার বড় বোন নুসরাত জাহান বাদি হয়ে রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেছেন। আর এ ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হত্যাকা- বলে দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে কলেজছাত্রীর পরিবার।
মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় ফিরে নগরীর বাগিচাগাঁও এলাকায় অরণী নামক ভবনের ফ্ল্যাটে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান। তিনি বলেন, দুই বছর আগে থেকে এক শিল্পপতীর সঙ্গে মুনিয়ার সম্পর্ক হয়। ওই সম্পর্কের পর তাদের মধ্যে অনেক কিছুই হয়েছে। তাকে রিকভার করে নিয়ে আসছিলাম। সে বেশ কিছুদিন আমার কাছে ছিল। এরপর গত দুইমাস আগে ঐ শিল্পপতী মুনিয়াকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়। তাকে বিয়ে করবে, তাকে অনেক ভালোবাসে। সে বলছে- তাকে এখানে সেটেল করতে পারবে না, দেশের বাইরে সেটেল করবে। এমন প্রলোভনের পর আমার বোন আমার কথা শুনে নাই। আমার বোনের অগাধ বিশ্বাস থেকে সে তার কাছে গিয়েছে। তাকে বাসা ভাড়া করে রেখেছে। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে মুনিয়ার মন খারাপ। এরপর বিয়ের কথা ঐ ছেলেকে বলেছিল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে।
কালকে মুনিয়া ফোন করে বলে- আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। আপু তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসো, আমার অনেক বড় বিপদ। আমার যে কোন সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়টি জেনে ঢাকায় রওয়ানা দেই এবং যেতে যেতে তাকে অনেক ফোন দেওয়া হয়, কিন্তু সে আর ফোন ধরেনি। পরে বাসায় গিয়ে দরজা নক করলেও সে খুলেনি। এসময় বাসার মালিককে ডেকে ঘরের তালা ভেঙ্গে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পাই। ওই বাসায় ঐ শিল্পপতীর আসা-যাওয়া করেছে সিসিটিভির এমন ফুটেজ পুলিশ পেয়েছে। ৪টি ডায়েরিতে মুনিয়ার লিখিত অনেক এভিডেন্স (তথ্য প্রমাণ) পাওয়া গেছে। এসব ডায়েরিতে অনেক এভিডেন্স আছে। দুটি মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য এভিডেন্স পুলিশ নিয়ে গেছে। বাসায় তার সাথে অনেক ছবি ছিল, সিমটম ছিল।
তিনি আরো বলেন, আমার কি গেছে, তা শুধু আমি বলতে পারব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। সরকার থেকে আমরা কিছুই নেই নাই। ওনার কাছে আমার এতিম বোনের বিচারটা ভিক্ষা চাই। সুষ্ঠু বিচার চাই।
এ বিষয়ে মুনিয়ার বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজ সাংবাদিকদের বলেন, আমার বোন মুনিয়া সুইসাইড করার মতো মেয়ে না। আমরা মনে করছি এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। আমি আপনাদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাতে চাই, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, পরিকল্পিত এই হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

গুলশান থানায় নাটকীয় চার ঘন্টা!
মোহাম্মদ ওমর ফারুক, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টিভি, ২৭/০৪/২০২১
রাত পৌনে এগারোটা। গুলশান থানা। কোথাও কেউ নেই। গাড়ির জানালা খুলতেই দেখলাম পুলিশ ভ্যানে করে একটি লাশ ঢুকছে। সেই লাশের পিছু নিয়ে থানায় ঢুকলাম। এর মধ্যে কানাঘুষা হচ্ছে বসুন্ধরার এমডির গার্লফ্র্রেন্ড আত্মহত্যা করেছে। অবশ্য এমন একটি তথ্য জেনেই ঘটনাস্থলে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যক্রমে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই ঘটনা আমার কাছে হাজির। থানায় ঢুকেই শুনেছি কয়েকজন কনস্টেবল বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। তাদের সঙ্গে আমিও গিয়ে যোগ দিলাম। কিন্তু তারা নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না। শুনা কথার মতো কথা বলছেন।
রাত সাড়ে এগারোটা। রিপোর্টার বলতে সেখানে আমিই উপস্থিত। এর মধ্যে কথা হয় থানার ওসি তদন্তের সঙ্গে। সে দেখি এই বিষয়ে খুব আগ্রহী। নিজেই এসে আমার সঙ্গে কথা বলছেন। আর কোনো টিভি চ্যানেল আসছে কীনা জিঙ্গেস করছেন। তখনো সে বিষয়টি সম্ভবতো অনুধাবন করতে পারেনি বেচারা। ভাবতে পারিনি কি ঘটতে যাচ্ছে। ঘটনা যত সময় নিচ্ছে, থানার পরিবেশ তত পিনপতন নীরবতা বাড়ছে। এই নীরবতা, কিছু চাপিয়ে যাওয়ার বা গোপন করার নীরবতা। রাত যত বাড়ছে ,একেক করে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থানায় ঢুকছে। রিপোর্টাররাও আসা শুরু করেছে। মজার ব্যপার হচ্ছে দুই তিনটি চ্যানেলের অ্যাসাইমেন্ট ছিলো প্রতিষ্ঠানের মালিক পর্যায়ের। তারা তখন নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে তাদের বসের বসদের। কিন্তু কিছুই অনএয়ার হচ্ছে না। বলে রাখা ভালো কয়েকজন রিপোর্টার এসে আবার চলেও গেছেন। তাদের ধারণা এটা বিশেষ কিছু বহন করবে না। বরং ঘটনা নিয়ে গেলেও অনএয়ার হবে না। তার চেয়ে বরং চলে যাওয়া ভালো। আমাকেও চলে যেতে বলছিলো তারা। তবে আমি নাছোড়বান্দা। আমি আর ডিবিসির জাহিদ ভাই রয়ে গেলাম। আমার উদ্দেশ্য অনএয়ার হোক বা না হোক আমি ঘটনার শেষটা দেখতে চাই ।
মানবজমিনের সম্পাদক প্রিয় মতি ভাই সবসময় একটা কথা বলতেন, ‘সব রিপোর্ট হয়তো প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু রিপোর্টারদের সময় একদিন আসেই। তাই ডকুমেন্টস যতœ করে রেখে দিতে হয়।’ যা হোক, আমি ঘটনার শেষ দেখতে চেয়েছিলাম। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ছিলাম।
এর মধ্যে থানার ভিতর যাচ্ছি, বের হচ্ছি। এভাবে পায়চারি করছি। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছেন না। না ভুক্তভোগী,না পুলিশের কেউ। ওই যে বলছিলাম ,ওসি তদন্ত খুব আগ্রহী ছিলো, সেও দেখি এখন আর তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। আমাকে এড়িয়ে চলছে। থানার ভিতর বাহির হওয়ার ধারাবাহিকতায় আরো একবার ভিতরে ঢুকে দেখলাম বসুন্ধরার এমডির সাথে ওই তরুণীর একটি ছবির অ্যালবাম পুলিশের কাছে। বাসায় টানানো দুই জনের একটি বড় ছবি। দু’টি ফোন। বাসা থেকে পুলিশ জব্দ করেছে এগুলো। এই ছবি দেখার পর, এবার আমার পুরোপুরি বিশ^াস হলো,ঘটনা ঠিক। তখনো এই বিষয়ে রিপোর্টার’রা পুরোপুরি কনর্ফাম না। এই ছবি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। ফোনের ক্যামেরাটা বের করলাম ,ছবি তুলার জন্য। কিন্তু বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশ সদস্যরা ছবিগুলো তরিগরি করে ওসি তদন্তের কক্ষে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। একধরনের সিলগালা। আমি আর ছবি নিতে পারিনি।
এদিকে এই সময়টা ধরে ওই তরুণীর বড়বোনকে দেখছি, এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে পুলিশের সঙ্গে ছুটাছুটি করছে। সাথে ভুক্তভোগীর বন্ধুবান্ধবরা। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। মিডিয়া দেখলেই দৌড়ে চলে যাচ্ছে, এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অন্যসব এমন ঘটনার উল্টো চিত্র। ভুক্তভোগীর পরিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে স্বেচ্ছায় কথা বলতে চায় এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের দেখে কখনোই স্বাভাবিক মনে হয়নি। যতেষ্ট আতঙ্ক ছিলো তাদের মধ্যে। এদিকে গুলশান জোনের পুলিশ সকল কর্মকর্তারা থানায় হাজির। ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং করছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়তো তারা কেউ পাচ্ছেন না। কোনো কোনো কর্মকর্তা বাইরে বের হয়ে এদিক ওদিক গিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন। পরিস্থিতি ঘটনাস্থলে না থাকলে বুঝা যাবে নাহ। তবে একটা বিষয় আমি কনর্ফাম ছিলাম, পরিবার মামলা করতে চাচ্ছে, কিন্তু পুলিশ চিন্তায় আছে। তারওপর আমরা বেশকয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী রয়েছি। স্টোরী অনএয়ার হোক বা হোক আমরা উপস্থিত থাকা কিন্তু তাদের জন্য একটু বাড়তি চাপ ছিলো। সেটা বুঝাই যাচ্ছিলো। তার মানে, দেশের এতো বড় একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চাচ্ছে পরিবার। কিন্তু পুলিশ স্বিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে? ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। তবে এই ঘটনায় কিন্তু স্পষ্ট বার্তা দেয়,দেশে আইন সবার জন্য সমান নয়। অন্য কেউ হলে কিন্তু বড়কর্তারা থানায় এসে মিটিং করতেন না। যা হোক বুদ্ধিজীবি টাইপের কথা বাদ দেই।

এসব ঘটনা দেখে রিপোর্টারদের মধ্যেও কানাঘুষা হচ্ছে। আসলে কি করতে যাচ্ছে পুলিশ? মামলা নিবে নাহ? সমঝোতা হয়ে যাবে? টাকার বিনিময় সমাধান হয়ে যাবে? এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কথার ফাকে এক এসআই রাত দুইটায় এসে বলছেন, মামলা হয়েছে। খবর দিয়ে দেন অফিসে। এই কথা শুনার পর সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো, এমডির বিরুদ্ধে মামলা! ক্ষণিকের মধ্যেই পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে থানায় যেন প্রাণ ফিরে এলো। সকল জল্পনা কল্পনা শেষ হলো। কিন্তু তখনো ভুক্তভোগীর পরিবার কথা বলতে চাইলেন না। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের লোকজন আলাদা আলাদা করে বের হয়ে গেলেন। যেন গণমাধ্যমের কেউ টের না পায়। সবার মধ্যে একধরনের চাপা আতঙ্ক। আমার অপেক্ষা করছি ভুক্তভোগীর বড় বোনের জন্য। যিনি এই মামলায় বাদী। মিনেট পাচেক পরেই বের হলেন তিনি। তিনিও কোনো কথা বলছেন না। তার চোখেমুখে আতঙ্কেও ছাপ! কি এমন আতঙ্ক? তারপরও তাকে আমরা ধরার চেষ্টা করলাম। কেউ কোনো কথা বলছেন না। তাকে বল্লাম, আপনি কি আপনার বোনের হত্যার বিচার চান না? তখন তিনি একটু নরম হয়ে কথা বলতে চাইলো,কিন্তু তার সঙ্গে লোকটি তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে ফেলেন। ফলে তার ইচ্ছে থাকা সত্বেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এতক্ষনে সকল টেলিভিশন চ্যানেল গুলশান থানায় হাজির। কারো কারো চোখে মুখে ঘুম স্পষ্ট ছিলো। সবশেষ,গুলশান জোনের ডিসি বীরের মতো ব্রিফিং করে, জানিয়ে দিলো, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবাহান আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যা প্ররোচনা অভিযোগে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগীর পরিবার। ডিসি বীরের মতো ব্রিফিং করলেও , পিছনের গল্পটা অন্য। হয়তো কোনো গ্রীন সিগনালের জন্য তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। এবং সেটা তিনি পেয়েছে। সব শেষ করে রাত তিনটা অফিসে ফিরলাম। স্টোরী রেডি করে সকাল আট’টায় অনএয়ার। আত্মহত্যা প্ররোচনা ঘটনায় বসুন্ধরার এমডির বিরুদ্ধে মামলা। টেলিভিশন হিসেব আমরাই প্রথম বিষয়টি অনএয়ার করেছি।
মা-বাবার কবরের পাশে সমাহিত মুনিয়া
রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া মোসারাত জাহান মুনিয়াকে মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) কুমিল্লা নগরীর টমছমব্রিজ কবরস্থানে আছর নামাজের পর জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।
সোমবার (২৬ এপ্রিল) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল হাসান তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর আগে, বিকেল ৪টায় তার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা থেকে কুমিল্লা বাগিচাগাঁওয়ে বড় বোনের বাসায় নিয়ে আসা হয়। কুমিল্লায় আসার পর মুনিয়ার বড় বোন ইসরাত জাহান তানিয়া জানান, মুনিয়া ডায়রি লিখতেন। সেখান থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে। তবে এটি কি আত্মহত্যা, নাকি হত্যা সেটি তদন্তেই বেরিয়ে আসবে। সোমবার আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করা হলেও স্বজনদের দাবি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। সন্ধ্যায় গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ফ্ল্যাটটিতে মুনিয়া একা থাকতেন।
ফ্লাশ ব্যাক : সানবীর কর্তৃক সাব্বির খুন
বসুন্ধরা গ্রুপের টেলিযোগাযোগ শাখার পরিচালক হুমায়ুন কবির সাব্বির হত্যা মামলা ধামাচাপা দিতে ১০০ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সম্মতিতে তার ছেলে তারেক রহমান ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর দলের খরচের নামে এ অর্থ দাবি করেন। পরে ৫০ কোটি টাকায় রফা হয়, যার ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন আসামী সানবীরের বাবা বসুন্ধরার চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান (শাহ আলম)। লুৎফুজ্জামান বাবর রিমান্ডে থাকা অবস্থায় যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলকে (টিএফআই) এসব কথা বলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। বসুন্ধরা গ্রুপের টেলিযোগাযোগ শাখার পরিচালক হুমায়ুন কবির সাব্বির গুলশানের একটি বাসায় খুন হন। হত্যাকান্ডের তদন্তে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তার ছেলে সানবীরের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠলে তারা বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বাবরের কাছে যান। এরপর হত্যাকান্ডটি ধামাচাপা দিতে বাবর ও তারেক বসুন্ধরা গ্রুপের কাছে ১০০ কোটি টাকা দলের খরচের নামে দাবী করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগন খালেদা জিয়ার সম্মতি ছিল। পরে ৫০ কোটি টাকায় বিষয়টি রফা হয়। এর মধ্যে ২০ কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়।
সূত্র জানায় বাবর স্বীকার করেন, বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলের চাপের কারণে পুলিশ মামলাটি দায়ের করে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে। জিজ্ঞাসাবাদে বাবর বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের চাপের কারণে মামলার অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার জন্য তিনি মামলাটি রেখে দেন। তিনি স্বীকার করেন, সাব্বির হত্যার মামলাটি তিনি প্রতিদিন নিজে তদারকি করতেন। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের সঙ্গে তিনি গোপন বৈঠক করেন। হত্যা মামলার আসামী সানবীরকে দেশ থেকে তিনি পালাতে সাহায্য করেন বলেও স্বীকার করেন। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার রাজ্জাক মামলাটি তদন্ত করেছেন। সুত্র জানায় বসুন্ধরার গোপন প্রমোদ কেন্দ্রে খুন হয়েছিল সাব্বির। মামলার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল কয়েকজন কলগার্ল। মামলার বিচার কাজ শুরু হলে সাক্ষীদেরকে ম্যানেজ করে আদালতে হাজির হতে না দেয়ায় সাক্ষীর অভাবে আসামীকে সাজা দিতে পারেনি আদালত।
শারুনের বিরুদ্ধে মুনিয়ার ভাইয়ের মামলার আবেদন
রাজধানীর গুলশানে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার আত্মহত্যার ঘটনায় জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়ার আদালতে এ আবেদন করেন মুনিয়ার ভাই মো. আশিকুর রহমান। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আদেশে উল্লেখ করেন, মুনিয়ার আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে গুলশান থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন। এ মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত হত্যা মামলার আবেদনটি স্থগিত থাকবে।
আগামী ৩০শে মে মামলার প্রতিবেদন দাখিলের কথা রয়েছে।
ক্রমাগত ‘হত্যার হুমকি’ পাচ্ছেন মুনিয়ার বোন
মুঠোফোনে ক্রমাগত হত্যার হুমকি পেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় করা মামলার বাদী নুসরাত জাহান। শনিবার কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় নিজের নিরাপত্তা চেয়ে ওই জিডি করেন তিনি।
এর আগে গত ২৬ এপ্রিল গুলশান-২-এর একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামের এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে গুলশান থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামি করেন।
জিডিতে নুসরাত জাহান উল্লেখ করেন, ওই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তাকে একাধিক মুঠোফোন নম্বর থেকে ফোন দিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে করে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই এ ঘটনায় নিরাপত্তা চেয়ে তিনি জিডি করেছেন।
কল রেকর্ডের ফরেনসিক চেয়ে নোটিশ
কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান ওরফে মুনিয়ার সঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কল রেকর্ড ফরেনসিক পর্যালোচনার জন্য আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবর এই নোটিশটি পাঠানো হয়।
নোটিশের ভাষ্য, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান ও নুসরাত জাহান মুনিয়ার মধ্যে কথোপকথনের একটি রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। ওই কল রেকর্ডে সায়েম সোবহান যেসব শব্দ ভিকটিম মুনিয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, তা যেকোনো নারীর জন্য অত্যন্ত অপমানজনক। উলি-খিত কল রেকর্ড ফরেনসিক পর্যালোচনার জন্য এবং যদি ফরেনসিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই ‘অশ্লীল শব্দ’ প্রয়োগকারী ব্যক্তি সায়েম সোবহান, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইয়াদিয়া জামান ওই আইনি নোটিশ পাঠান। রেজিস্ট্রি ডাকযোগে স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবর ওই আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে জানিয়ে ইয়াদিয়া জামান প্রথম আলোকে বলেন, ভাইরাল হওয়া ওই কল রেকর্ড ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশের উল্লিখিত বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম না দেখা গেলে পরে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এর আগে ২৬ এপ্রিল রাতে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মোসারাতের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মোসারাতের বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। এ মামলার একমাত্র আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর।
এই মামলার পরদিন সায়েম সোবহান আনভীরের বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করে পুলিশ, ওই আবেদন সেদিন মঞ্জুর করেন আদালত। এর মধ্যে ২৮ এপ্রিল হাইকোর্টে আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেন আনভীর। ওই ঘটনায় ২ মে মুনিয়ার ভাই আশিকুর রহমান হত্যা মামলা নিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন।
বসুন্ধরার আনভীর-সানভীর সমানে সমান
সায়েম সোবহান আনভীর এবং সাফিয়াত সোবহান সানভীর দুই ভাই। আহমেদ আকবর সোবহানের দুই ছেলে। দেশের বৃহত্তম শিল্প গোষ্ঠির অন্যতম বসুন্ধরার মালিক বললে চিনতে আরো সহজ হয়। পিতার অঢেল অর্থ বিত্তের সাম্রাজ্যে বেড়ে উঠা সানভীর-আনভীর দুইভাই। এতদিন সাব্বির হত্যা মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে সানভীর আলোচিত সমালোচিত ছিলেন। এখন আনভীর একইভাবে আলোচিত সমালোচিত হচ্ছেন মোসারাত জাহান মুনিয়ার আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার মামলায়। এ যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। কেহ কাহারে নাহি ছাড়ে সমানে সমানে। সানভীর বহুল আলোচিত সাব্বির হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত। হুমায়ুন কবীর সাব্বির বসুন্ধরা টেলিকমের পরিচালক ছিলেন। পিতা আকবর সোবহানের সাম্রাজ্যের সবকিছুতে নিশ্চয়ই সমানে সমান অধিকার তাদের। অপকর্মেও তারা সমানে সমান নজির রাখছেন। ২০০৬ সালের ৪ জুলাই রাতে গুলশানের একটি বাড়িতে খুন হন বসুন্ধরা টেলিকমিউনিকেশসন্স নেটওয়ার্ক লিমিটেডের পরিচালক সাব্বির। এর তিন দিন পর নিহতের ভগ্নিপতি এএফএম আসিফ একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট মো. আরমান আলী ২০০৮ সালের ১২ মে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন। এতে বলা হয়, গুলশানের ১০৪ নম্বর সড়কে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ৩/জি নম্বর বাসার ছাদ থেকে সাব্বিরকে ফেলে দেওয়া হয়। সাব্বির খুন হওয়ার কিছুদিন পর সানবীর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তাকে দেশত্যাগে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ ছিলো। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাবর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন যে তিনি সানবীরকে খুনের মামলা থেকে বাঁচাতে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের কাছ থেকে ২১ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলা বিচারাধীন। সাব্বির হত্যার রায়ে বিচারক মোতাহার হোসেন বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ বস্তুনিষ্ঠ, প্রকৃত ও বাস্তব সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় পাঁচ আসামির সবাইকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো। তার থেকেও অবাক করা হচ্ছে তখন রায় ঘোষণার সময় বাদীপক্ষের কাউকে এজলাসে পাওয়া যায়নি। যাহোক সকল আসামী বেকসুর খালাস। সেক্ষেত্রে সাব্বির হত্যা আর মুনিয়ার আত্মতহ্যা (এখনো তদন্তাধীন) অনেক ভিন্ন। আনবীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগ। তিনিও একইভাবে দেশ ত্যাগ করেছেন। এও শোনা যাচ্ছে বিমানবন্দর দিয়ে এ নামে কেহ যায়নি। তবে তাকে পুলিশ এখনো ধরেওনি। আনবীর ইতমধ্যেই আগাম জামিনের আবেদন করেছেন। ওইদিন (মুনিয়ার কথিত আত্মহত্যার দিন সোমবার) সন্ধায় এক বিশেষ কার্গো ফ্লাইটে আনভিরের স্ত্রীর ডুবাই যাবার খবর নিশ্চিত করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। গণমাধ্যমে ফলাওভাবে প্রচারও পেয়েছে তা। তিনি (আনবীরের স্ত্রীর কার্গো ফ্লাইটে) এভাবে পড়িমড়ি পালাবেন কেন? এখানে কিছুটা রহস্যের আভাস রয়েছে। এসবই গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে আমাদের অভিজ্ঞতা এবং ধারনা প্রসুত মতামত। পাশাপাশি বিত্তের কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণের সাক্ষি হওয়া। তবে এসব কাহিনী স্রেফ লিখা নয়। মনে রাখতে হবে, যে কোন অন্যায় অত্যাচারের একটি পরিণতি থাকে। লিখা আমাদের কাজ। যদি এটুকু দায়িত্ব পালনও না করি তবে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। কর্তব্যবোধ থেকেই লিখছি। লিখছি কারন পৃথিবীর ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। প্রকৃতি নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নেয়। আমাদের কর্মফল জীবিতকালে পৃথিবীতে এবং মৃত্যুর পর পরকালে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। বাংলাদেশে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাভোগ করেছেন। আনভীর-সানভীর কি তার থেকেও বড় হয়ে গেছে নাকি। সময়ই বলে দেবে। অর্থের বিনিময়ে আইন-আদালত-মানুষ-সমাজ সব কিছু সাময়িক ধামাচাপা হবে হয়তো। অথবা অর্থের কাছে মাথানত হচ্ছে ভুক্তভোগিরা। কিন্তু প্রকৃতিকে কোনভাবেই বশে আনা যায় না। ন্যায় সময়ের মুখাপেক্ষী। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবেই হবে। সময়ের অপেক্ষা। অত্যাচারী কেহই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারেনি। আনভীর-সানভীরও দোষী হলে টিকে থাকবে না। জনসাধারণ হিসাবে আমাদের সবথেকে বড় ভরসার স্থল হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের কাছে জনাসাধারণ সঠিক ন্যায় বিচার পাবে এটাই তার কাম্য। রাষ্ট্র স্বাধীন। জনসাধারণও নিজেকে স্বাধীন বলে দাবি করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের অনুপ্রেরণা আমাদের আশাণ্বিত হতে সাহস যোগায়। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মানবতার জননী শেখ হাসিনা আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তার সরকার নিশ্চয়ই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করবে।